পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\υ Σ. Ο রবীন্দ্র-রচনাবলী গোরা কহিল, “অর্থাৎ, সংক্ষেপে, তুমি ব্ৰাহ্ম হবে ?” বিনয় কহিল, “না।” গোরা কহিল, “ললিতাকে তুমি বিয়ে করবে ?” বিনয় কহিল, “তঁহা ।” গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “হিন্দুবিবাহ ?” বিনয় কহিল, “হা ।” গোরা। পরেশবাবু তাতে সম্মত আছেন ? বিনয় । এই তার চিঠি । গোরা পরেশের চিঠি দুইবার করিয়া পড়িল। তাহার শেষ অংশে ছিল— “আমার ভালো-মন্দ লাগার কোনো কথা তুলিব না, তোমাদের সুবিধা-অসুবিধার কোনো কথাও পাড়িতে চাই না । আমার মত-বিশ্বাস কী, আমার সমাজ কী, সে তোমরা জান, ললিতা ছেলেবেলা হইতে কী শিক্ষা পাইয়াছে এবং কী সংস্কারের মধ্যে মানুষ হইয়াছে তাও তোমাদের অবিদিত নাই। এ-সমস্তই জানিয়া শুনিয়া তোমাদের পথ তোমরা নির্বাচন করিয়া লইয়ােছ। আমার আর-কিছুই বলিবার নাই। মনে করিয়ো না, আমি কিছুই না ভাবিয়া অথবা ভাবিয়া না পাইয়া হাল ছাড়িয়া দিয়াছি। আমার যতদূর শক্তি আমি চিন্তা করিয়াছি । ইহা বুঝিয়াছি তোমাদের মিলনকে বাধা দিবার কোনো ধর্মসংগত কারণ নাই, কেননা, তোমার প্রতি আমার সম্পূৰ্ণ শ্রদ্ধা আছে। এ স্থলে সমাজে যদি কোনো বাধা থাকে। তবে তাহাকে স্বীকার করিতে তোমরা বাধ্য নও । আমার কেবল এইটুকুমাত্র বলিবার আছে, সমাজকে যদি তোমরা লঙঘন করিতে চাও তবে সমাজের চেয়ে তোমাদিগকে বড়ো হইতে হইবে । তোমাদের প্ৰেম, তোমাদের সম্মিলিত জীবন, কেবল যেন প্ৰলয় শক্তির সূচনা না করে, তাহাতে সৃষ্টি ও স্থিতির তত্ত্ব থাকে যেন । কেবল এই একটা কাজের মধ্যে হঠাৎ একটা দুঃসাহসিকতা প্রকাশ করিলে চলিবে না, ইহার পরে তোমাদের জীবনের সমস্ত কা সবে বীরত্বের সূত্রে গাথিয়া তুলিতে হইবে।— নিহিলে তোমরা অত্যন্ত নামিয়া পড়িবে। কেননা, বাহির হইতে সমাজ তোমাদিগকে সর্বসাধারণের সমান ক্ষেত্রে আর বহন করিয়া রাখিবে না, তোমরা নিজের শক্তিতে এই সাধারণের চেয়ে বড়ো যদি না হও তবে সাধারণের চেয়ে তোমাদিগকে নামিয়া যাইতে হইবে । তোমাদের ভবিষ্যৎ শুভাশুভের জন্য আমার মনে যথেষ্ট আশঙ্কা রহিল । কিন্তু এই আশঙ্কার দ্বারা তোমাদিগকে বাধা দিবার কোনো অধিকার আমার নাইকারণ, পৃথিবীতে যাহারা সাহস করিয়া নিজের জীবনের দ্বারা নব নব সমস্যার মীমাংসা করিতে প্ৰস্তুত হয় তাহারাই সমাজকে বড়ো করিয়া তুলে। যাহারা কেবলই বিধি মানিয়া চলে তাহারা সমাজকে বহন করে মাত্র, তাহাকে অগ্রসর করে না । অতএব আমার ভীরুতা আমার দুশ্চিন্তা লইয়া তােমাদের পথ আমি রোধ করিব না। তােমরা যাহা ভালো বুঝিয়াছ সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তাহা পালন করো, ঈশ্বর তোমাদের সহায় হউন । ঈশ্বর কোনো-এক অবস্থার মধ্যে র্তাহার সৃষ্টিকে শিকল দিয়া বাধিয়া রাখেন না, তাহাকে নব নব পরিণতির মধ্য চির নবীন করিয়া জগাইয়া তুলিতেছেন ; তোমরা তাহার সেই উদবােধনের দৃতরূপে নিজের জীবনকে মশালের মতো জ্বালাইয়া দুৰ্গম পথে অগ্রসর হইতে চলিয়াছ, যিনি বিশ্বের পথচালক তিনিই তোমাদিগকে পথ দেখান— আমার পথেই তোমাদিগকে চিরদিন চলিতে হইবে এমন অনুশাসন আমি প্রয়োগ করিতে পারিব না। তোমাদের বয়সে আমরাও একদিন ঘাট হইতে রশি খুলিয়া ঝড়ের মুখে নীেকা ভাসাইয়াছিলাম, কাহারও নিষেধ শুনি নাই। আজও তাহার জন্য অনুতাপ করি না। যদিই অনুতাপ করিবার কারণ ঘটিত তাহাতেই বা কী ? মানুষ ভুল করিবে, ব্যর্থও হইবে, দুঃখও পাইবে, কিন্তু বসিয়া থাকিবে না ; যাহা উচিত বলিয়া জানিবে তাহার জন্য আত্মসমৰ্পণ করিবে ; এমনি করিয়াই পবিত্রসলিলা সংসারনদীর স্রোত চিরদিন প্রবহমান হইয়া বিশুদ্ধ থাকিবে । ইহাতে মাঝে মাঝে ক্ষণকালের জন্য তীর ভাঙিয়া ক্ষতি করিতে পারে এই আশঙ্কা করিয়া চিরদিনের জন্য স্রোত