পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ΝοΣ Ο মধ্যে ব্রাহ্মসমাজে ঢুকবে এমন আশঙ্কা নেই।” মহিম কহিলেন, “তা নেই বটে, কিন্তু বাবার শরীর ইদানীং বড়ো খারাপ হয়ে উঠেছে সেটা তোমরা লক্ষ্য করে দেখছি না। ডাক্তারেরা যতই আপত্তি করছে ওঁর নিয়মের মাত্রা আরো ততই বাড়িয়ে তুলছেন। আজকাল যে সন্ন্যাসী ওঁর সঙ্গে জুটেছে সে ওঁকে তিন বেলা স্নান করায়, তার উপরে আবার এমনি হঠযোগ লাগিয়েছে যে চােখের তারা-ভুরু নিশ্বাসপ্রশ্বাস নাড়িটাড়ি সমস্ত একেবারে উলটো-পালটা হবার জো হয়েছে। বাবা বেঁচে থাকতে থাকতে শশীর বিয়েটা হয়ে গেলেই সুবিধা হয়- ওঁর পেনশনের জমা টাকাটা ওঙ্কারানন্দস্বামীর হাতে পড়বার পূর্বেই কাজটা সারিতে পারলে আমাকে বেশি ভাবতে হয় না। বাবার কাছে কথাটা কাল পেড়েওছিলুম, দেখলুম। বড়ো সহজ ব্যাপার নয়। ভেবেছি। ঐ সন্ন্যাসী বেটাকে কিছুদিন খুব কষে গাজা খাইয়ে বশ করে নিয়ে, ওরই দ্বারা কাজ উদ্ধার করতে হবে । যারা গৃহস্থ, যাদের টাকার দরকার সব চেয়ে বেশি, বাবার টাকা তাদের ভোগে আসবে না। এটা তুমি নিশ্চয় জেনে | আমার মুশকিল হয়েছে এই যে, অন্যের বাবা কষে টাকা তলব করে আর নিজের বাবা টাকা দেবার কথা শুনলেই প্ৰাণায়াম করতে বসে যায় । আমি এখন ঐ এগারো বছরের মেয়েটাকে গলায় বেঁধে কি জলে ডুব দিয়ে মরব ?” ܔܢ হরিমোহিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাধারানী, কাল রাত্রে তুমি কিছু খেলে না কেন ?” হরিমোহিনী তাহার ঢাকা খাবার দেখাইয়া কহিলেন, “কোথায় খেয়েছ ? ঐ-যে পড়ে রয়েছে।” তখন সুচরিতা বুঝিল, কাল খাবার কথা তাহার মনেই ছিল না। হরিমোহিনী রুক্ষ স্বরে কহিলেন, “এ-সব তো ভালো কথা নয়। আমি তোমাদের পরেশবাবুকে যতদূর জানি, তিনি যে এতদূর সব বাড়াবাড়ি ভালোবাসেন তা তাে আমার মনে হয় না— তাকে দেখলে মানুষের মন শান্ত হয় । তোমার আজকালকার ভাবগতিক তিনি যদি সব জানতে পারেন তা হলে কী বলবেন বলো দেখি ।” হরিমোহিনীর কথার লক্ষ্যটা কী তাহা সুচরিতার বুঝিতে বাকি রহিল না। প্রথমটা মুহুর্তকালের জন্য তাহার মনের মধ্যে সংকোচ আসিয়াছিল। গোরার সহিত তাহার সম্বন্ধকে নিতান্ত সাধারণ পড়িতে পারে এ কথা সে কখনাে চিন্তাই করে নাই। সেইজন্য হরিমোহিনীর বক্রোক্তিতে সে কুষ্ঠিত হইয়া পড়িল। কিন্তু পরীক্ষণেই হাতের কাজ ফেলিয়া সে খাড়া হইয়া বসিল এবং হরিমােহিনীর মুখের দিকে চােখ তুলিয়া চাহিল । গোরার কথা লইয়া সে মনের মধ্যে কাহারও কাছে কোনো লজ্জা রাখিবে না। ইহা মুহুর্তের মধ্যে সে স্থির করিল, এবং কহিল, “মাসি, তুমি তো জািন, কাল গৌরমোহনবাবু এসেছিলেন। তার সঙ্গে আলাপের বিষয়টি আমার মনকে খুব অধিকার করে বসেছিল, সেইজন্যে আমি খাবারের কথা ভুলেই গিয়েছিলুম। তুমি থাকলে কাল অনেক কথা শুনতে পেতে ।” 省 হরিমোহিনী যেমন কথা শুনিতে চান গোরার কথা ঠিক তেমনটি নহে। ভক্তির কথা শুনিতেই তাহার আকাঙক্ষা ; গােরার মুখে ভক্তির কথা তেমন সরল ও সরস হইয়া বাজিয়া ওঠে না। গােরার সম্মুখে বরাবর যেন একজন প্রতিপক্ষ আছে ; তাহার বিরুদ্ধে গােরা কেবলই লড়াই করিতেছে। যাহারা মানে না তাহাদিগকে সে মানাইতে চায়, কিন্তু যে মানে তাহাকে সে কী বলিবে । যাহা লইয়া গোরার উত্তেজনা হরিমােহিনী তাহাতে সম্পূর্ণ উদাসীন। ব্ৰাহ্মসমাজের লােক যদি হিন্দুসমাজের সহিত নী মিলিয়া নিজের মত লইয়া থাকে তাহাতে তাহার আন্তরিক ক্ষোভ কিছুই নাই, তাহার নিজের প্রিয়জনগুলির সহিত তাহার বিচ্ছেদের কোনাে কারণ না ঘটিলেই তিনি নিশ্চিন্ত থাকেন। এইজন্য গীেরীর সঙ্গে আলাপ করিয়া তাহার হৃদয় লেশমাত্র রস পায় নাই। ইহার পরে হরিমােহিনী যখনই حجم