পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা じ○○ তাহাকে তাহার উপাসনার নিভৃত ঘরটির মধ্যে লইয়া গেল— সেখানে যথানিয়মে আসন পাত এবং একটি * অবশেষে একটি ছােটাে প্রার্থনা করিয়া তিনি উঠিয়া আসিলেন । বাহিরে আসিতেই দেখিলেন, উপাসনা-ঘরের দ্বারের কাছে বাহিরে ললিতা ও বিনয় চুপ করিয়া বসিয়া আছে। তঁহাকে দেখিয়াই তাহারা দুইজনে প্ৰণাম করিয়ু তাহার পুয়ের ধূলা লইলু। তিনি তাহাদের মুথায় হাত রাখিয়া মনে মনে আশীর্বাদ করিলেন। সুচরিতাকে কহিলেন, “মা, আমি কাল তোমাদের বাড়িতে যাব, আজ আমার কাজটা সেরে আসি গে৷ ” বলিয়া তাহার ঘরে চলিয়া গেলেন । তখন সুচরিতার চােখ দিয়া জল পড়িতেছিল। সে নিস্তব্ধ প্রতিমার মতাে নীরবে বারান্দায় অন্ধকারে দাড়াইয়া রহিল। ললিতা এবং বিনয়ও অনেকক্ষণ কিছু কথা কহিল না। সুচরিতা যখন চলিয়া যাইবার উপক্ৰম করিল বিনয় তখন তাহার সম্মুখে আসিয়া মৃদুস্বরে কহিল, এই বলিয়া ললিতাকে লইয়া সুচরিতাকে প্ৰণাম করিল ; সুচরিতা অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে যাহা বলিল তাহা তাহার অন্তর্যামীই শুনিতে পাইলেন । পরেশবাবু তাহার ঘরে আসিয়া ব্রাহ্মসমাজ-কমিটির নিকট পত্র লিখিলেন ; তাহাতে লিখিলেন“ললিতার বিবাহ আমাকেই সম্পাদনা করিতে হইবে । ইহাতে আমাকে যদি ত্যাগ করেন তাহাতে আপনাদের অন্যায় বিচার হইবে না। এক্ষণে ঈশ্বরের কাছে আমার এই একটিমাত্র প্রার্থনা রহিল তিনি আমাকে সমস্ত সমাজের আশ্রয় হইতে বহির করিয়া লইয়া তঁহারই পদপ্রান্তে স্থান দান করুন { واما সুচরিতা পরেশের কাছে যে কথা কয়টি শুনিল তাহা গােরাকে বলিবার জন্য তাহার মন অতান্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিল। যে ভারতবর্ষের অভিমুখে গোরা তাহার দৃষ্টিকে প্রসারিত এবং চিত্তকে প্রবল প্রেমে আকৃষ্ট করিয়াছে, এত দিন পরে সেই ভারতবর্ষে কালের হস্ত পড়িয়াছে, সেই ভারতবর্ষ ক্ষয়ের মুখে চলিয়াছে, সে কথা কি গোরা চিন্তা করে নাই ? এতদিন ভারতবর্ষ নিজেকে বাচাইয়া রাখিয়াছে তাহার আভ্যন্তরিক ব্যবস্থার বলে ; সেজন্য ভারতবাসীকে সতর্ক হইয়া চেষ্টা করিতে হয় নাই। আর কি তেমন নিশ্চিন্ত হইয়া বাঁচিবার সময় আছে ? আজ কি পূর্বের মতাে কেবল পুরাতন ব্যবস্থাকে আশ্রয় করিয়া ঘরের মধ্যে বসিয়া থাকিতে পারি ? সুচরিতা ভাবিতে লাগিল, ইহার মধ্যে আমারও তো একটা কাজ আছে— সে কাজ কী ? গোরার উচিত ছিল এই সময়ে তাহার সম্মুখে আসিয়া তাহাকে আদেশ করা, তাহাকে পথ দেখাইয়া দেওয়া। সুচরিতা মনে মনে কহিল, "আমাকে তিনি যদি আমার সমস্ত বাধা ও অজ্ঞতা হইতে উদ্ধার করিয়া 端 য়াও তাহার মূল ছাপাইয়া উঠিত না ? সুচরিতার মন আত্মগীেরবে পূর্ণ হইয়া দাঁড়াইল। সে বলিল— গােরা কেন তাহাকে পরীক্ষা করিলেন না, কেন তাহাকে অসাধ্য সাধন করিতে বললেন নী— গােরার দলের সমস্ত পুরুষের মধ্যে এমন একটি লোক কে আছে যে সুচরিতার মতাে এমন অনায়াসে নিজের যাহা-কিছু আছে সমস্ত উৎসর্গ করতে পারে ? এমন একটা আত্মত্যাগের আকাঙ্ক্ষা ও শক্তির কি কোনাে প্রয়ােজন গােরা দেখিল না ? ইহাকে লোকলজ্জার-বেড়া-দেওয়া কর্মহীনতার মধ্যে ফেলিয়া দিয়া গেলে তাহাতে দেশের কিছুমাত্র ক্ষতি নাই ? সুচরিতা এই অবজ্ঞাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করিয়া দূরে সরাইয়া দিল। সে কহিল, "আমাকে এমন করিয়া ত্যাগ করবেন। এ কখনােই