পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ᏔᎼ8ᏔᏬ বিনয় চুপ করিয়া রহিল। গেরা হৃদয়ের বেদনা সম্পূর্ণ গোপন করিয়া হাসিয়া কহিল, “আমি নাইবা গেলুম, তাতে কী ? তোমারই তো জিত হয়েছে। তুমি তো মাকে টেনে নিয়ে গেছ। এত চেষ্টা করলুম, তাকে তো কিছুতে ধরে রাখতে পারলুম না। শেষে আমার মাকে নিয়েও তোমার কাছে আমার হার মানতে হল। বিনয়, একে একে “সব লাল হাে জায়গা নাকি ! আমার মানচিত্রটাতে কেবল আমিই একলা এসে ঠেক’ব ।” বিনয় কহিল, “ভাই, আমাকে দোষ দিয়ে না। কিন্তু। আমি তাকে খুব জোর করেই বলেছিলুম, মা, আমার বিয়েতে তুমি কিছুতেই যেতে পাবে না।” মা বললেন, “দেখ বিনু, তোর বিয়েতে যারা যাবে না তারা তোর নিমন্ত্রণ পেলেও যাবে না, আর যারা যাবে তাদের তুই মানা করলেও যাবে- সেইজন্যেই তোকে বলি, তুই কাউকে নিমন্ত্রণও করিস নে, মানাও করিস নে, চুপ করে থাক।” গোরা, তুমি কি আমার কাছে হার মেনেছ ? তোমার মা'র কাছে তোমার হার— সহস্রাবার হার । অমন মা কি আর আছে ।” গোরা যদিচ আনন্দময়ীকে বদ্ধ করিবার জন্য সম্পূর্ণ চেষ্টা করিয়াছিল, তথাপি তিনি যে তাহার কোনো বাধা না মানিয়া, তাহার ক্রোধ ও কষ্টকে গণ্য না করিয়া বিনয়ের বিবাহে চলিয়া গেলেন, ইহাতে গোরা তাহার অন্তরতর হৃদয়ের মধ্যে বেদনা বোধ করে নাই, বরঞ্চ একটা আনন্দ লাভ করিয়াছিল। বিনয় তাহার মাতার অপরিমেয় মেহের যে অংশ পাইয়াছিল, গোরার সহিত বিনয়ের যতবড়ো বিচ্ছেদই হউক, সেই গভীর স্নেহসুধার অংশ হইতে তাহাকে কিছুতেই বঞ্চিত করিতে পরিবে না ইহা নিশ্চয় জানিয়া গোরার মনের ভিতরে একটা যেন তৃপ্তি ও শান্তি জন্মিল। আর-সব দিকেই বিনয়ের কােছ হইতে সে বহু দূরে যাইতে পারে, কিন্তু এই অক্ষয় মাতৃস্নেহের এক বন্ধনে অতি নিগুঢ় রূপে এই দুই চিরবন্ধু চিরদিনই পরস্পরের নিকটতম হইয়া থাকিবে। বিনয় কহিল, “ভাই, আমি তবে উঠি । নিতান্ত না যেতে পার যেয়ে না, কিন্তু মনের মধ্যে অপ্ৰসন্নতা রেখে না গোরা ! এই মিলনে আমার জীবন যে কতবড়ো একটা সার্থকতা লাভ করেছে, তা যদি মনের মধ্যে অনুভব করতে পার তা হলে কখনো তুমি আমাদের এই বিবাহকে তোমার সৌহৃদ্য থেকে নির্বাসিত করতে পারবে না- সে আমি তোমাকে জোর করেই বলছি।” এই বলিয়া বিনয় আসন হইতে উঠিয়া পড়িল । গোরা কহিল, “বিনয়, বোসো । তোমাদের লগ্ন তো সেই রাত্রে- এখন থেকেই এত তাড়া কিসের ” বিনয় গোরার এই অপ্রত্যাশিত সস্নেহ অনুরোধে বিগলিতচিত্তে তৎক্ষণাৎ বসিয়া পড়িল । তার পর অনেক দিন পরে আজ এই ভোরবেলায় দুইজনে পূর্বকালের মতো বিশ্ৰাম্ভালপে প্রবৃত্ত হইল। বিনয়ের হৃদয়বীণায় আজকাল যে তারটি পঞ্চম সুরে বাধা ছিল গোরা সেই তারেই আঘাত করিল। বিনয়ের কথা আর ফুরাইতে চাহিল না। কত নিতান্ত ছোটাে ছোটাে ঘটনা যাহাকে সাদা কথায় লিখিত গেলে অকিঞ্চিৎকর, এমন-কি, হাস্যকর বলিয়া বোধ হইবে, তাহারই ইতিহাস বিনয়ের মুখে যেন গানের তানের মতো বারংবার নব নব মাধুর্যে উচ্ছসিত হইয়া উঠিতে লাগিল। বিনয়ের হৃদয়ক্ষেত্রে আজকাল যে একটি আশ্চর্য লীলা চলিতেছে, তাহারই সমস্ত অপরূপ রাসবৈচিত্র্য বিনয় আপনার নিপুণ ভাষায় অতি সূক্ষ্মী অথচ গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করিয়া বৰ্ণনা করিতে লাগিল। জীবনের এ কী অপূর্ব অভিজ্ঞতা! বিনয় যে অনির্বচনীয় পদার্থটিকে হৃদয় পূর্ণ করিয়া পাইয়াছে, এ কি সকলে পায়! ইহাকে গ্ৰহণ করিবার শক্তি কি সকলের আছে ? সংসারে সাধারণত স্ত্রীপুরুষের যে মিলন দেখা যায়, বিনয় কহিল, তাহার মধ্যে এই উচ্চতম সুরটি তো বাজিতে শুনা যায় না। বিনয় গোরাকে বার বার করিয়া কহিল, অন্য সকলের সঙ্গে সে যেন তাঁহাদের তুলনা না করে। বিনয়ের মনে হইতেছে ঠিক এমনটি আর কখনো ঘটিয়াছে কি না সন্দেহ। এমন যদি সচরাচর ঘটিতে পারিত তবে বসন্তের এক হাওয়াতেই যেমন সমস্ত বন নব নব পুষ্পপল্পবে পুলকিত হইয়া উঠে সমস্ত সমাজ তেমনি প্রাণের হিল্লোলে চারিদিকে চঞ্চল হইয়া উঠিত। তাহা হইলে লোকে এমন করিয়া খাইয়া-দাইয়া ঘুমাইয়া দিব্য তৈলচিঙ্কণ হইয়া কাটাইতে পারিত না । তাহা হইলে যাহার মধ্যে যত সৌন্দৰ্য যত শক্তি আছে