পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা VGd কোনো বাধা ঘটাইয়াছে ? তাহাকে গোরার দান করিবার এবং তাহার নিকট প্রত্যাশা করিবার আর কিছুই নাই ? সে কিন্তু এমন করিয়া ভাবে নাই। সে কিন্তু এখনো পথ চাহিয়া ছিল। সুচরিতা নিজের ভিতরকার এই অসহ্য কষ্টের বিরুদ্ধে লড়াই করিবার জন্য প্ৰাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিল, কিন্তু সে মনের মধ্যে কোথাও কিছুমাত্র সান্তুনা পাইল না। ’ হরিমোহিনী সুচরিতাকে অনেকক্ষণ ভাবিবার সময় দিলেন। তিনি তাহার নিত্য নিয়মমত একটুখানি ঘুমাইয়াও লইলেন। ঘুম ভাঙিয়া সুচরিতার ঘরে আসিয়া দেখিলেন, সে যেমন বসিয়া ছিল তেমনিই চুপ করিয়া বসিয়া আছে। ¢ት তিনি কহিলেন, “রাধু, অত ভাবছিস কেন বল দেখি ? এর মধ্যে ভাববার অত কী কথা আছে ? কেন, গৌরমোহনবাবু অন্যায় কিছু লিখেছেন ?” সুচরিতা শাস্তম্বরে কহিল, “না, তিনি ঠিকই লিখেছেন।” সুচরিতা কহিল, "না, দেরি করতে চাই নে, আমি একবার বাবার ওখানে যাব।” হরিমোহিনী কহিলেন, “দেখো রাধু, তোমার যে হিন্দুসমাজে বিবাহ হবে এ তোমার বাবা কখনো ইচ্ছা করবেন না, কিন্তু তোমার গুরু যিনি তিনি-” সুচরিতা অসহিষ্ণু হইয়া বলিয়া উঠিল, “মাসি, কেন তুমি বার বার ঐ এক কথা নিয়ে পড়েছ ? বিবাহ নিয়ে বাবার সঙ্গে আমি কোনো কথা বলতে যাচ্ছি নে । আমি তার কাছে অমনি একবার যাব ।” পরেশের সান্নিধ্যই যে সুচরিতার সান্তুনার স্থল ছিল। পরেশের বাড়ি গিয়া সুচরিতা দেখিল, তিনি একটা কাঠের তেরঙ্গে কাপড়চোপড় গোছাইতে ব্যস্ত । সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, একি ?” পরেশ একটু হাসিয়া কহিলেন, “মা, আমি সিমলা পাহাড়ে বেড়াতে যাচ্ছি- কাল সকালের গাড়িতে রওনা হব ।” পরেশের এই হাসিটুকুর মধ্যে মস্ত একটা বিপ্লবের ইতিহাস প্রচ্ছন্ন ছিল তাহা সুচরিতার অগোচর রহিল না। ঘরের মধ্যে র্তাহার স্ত্রী কন্যা ও বাহিরে তঁহার বন্ধুবান্ধবেরা তঁহাকে একটুও শান্তির অবকাশ দিতেছিল না। কিছুদিনের জন্যও যদি তিনি দূরে গিয়া কাটাইয়া না আসেন, তবে ঘরে কেবলই তাঁহাকে কেন্দ্ৰ করিয়া একটা আবর্ত ঘুরিতে থাকিবে। কাল তিনি বিদেশে যাইবার সংকল্প করিয়াছেন, অথচ আজ তাহার। আপনার লোক কেহই তাহার কাপড় গুছাইয়া দিতে আসিল না, তাহার নিজেকেই এ কাজ করিতে হইতেছে, এই দৃশ্য দেখিয়া সুচরিতার মনে খুব একটা আঘাত লাগিল । সে পরেশবাবুকে নিরস্ত করিয়া প্রথমে তাহার তোরঙ্গ সম্পূর্ণ উজাড় করিয়া ফেলিল। তাহার পরে বিশেষ যত্নে ভঁাজ করিয়া কাপড়গুলিকে নিপুণহন্তে তেরঙ্গের মধ্যে আবার সাজাইতে লাগিল, এবং তাহার সর্বদা পাঠ্য বইগুলিকে এমন করিয়া রাখিল যাহাতে নাড়াচাড়াতেও তাঁহাদের আঘাত না লাগে । এইরূপে বাক্স গুছাইতে গুছাইতে সুচরিতা আস্তে আন্তে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, তুমি কি একলাই যাবে ?” পরেশ সুচরিতার এই প্রশ্নের মধ্যে বেদনার আভাস পাইয়া কহিলেন, “তাতে আমার তো কোনো কষ্ট নেই রাধে ।” সুচরিতা কহিল, “না। বাবা, আমি তোমার সঙ্গে যাব।” পরেশ সুচরিতার মুখের দিকে চাহিয়া ছিলেন। সুচরিতা কহিল, “বাবা, আমি তোমাকে কিছু বিরক্ত করব না ।” পরেশ কহিলেন, “সে কথা কেন বলছ ? আমাকে তুমি কবে বিরক্ত করেছ মা ?” সুচরিতা কহিল, “তোমার কাছে না থাকলে আমার ভালো হবে না বাবা। আমি অনেক কথাই বুঝতে পারি নে। তুমি আমাকে বুঝিয়ে না দিলে আমি কিনারা পাব না। বাবা, তুমি যে আমাকে