পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ጏዒ 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আসিতেছে ; আমরা কি তাহার উত্তরে দুটি-চারটি চটি চটি ইংরেজি খবরের কাগজ লিখিব ! সকল দেশ অসীম কালের পটে নিজ নিজ নাম খুন্দিতেছে, বাঙালির নাম কি কেবল দরখাস্তের দ্বিতীয় পাতেই লেখা থাকিবে ! জড় অদৃষ্টর সহিত মানবাত্মার সংগ্রাম চলিতেছে, সৈনিকদিগকে আহবান করিয়া পৃথিবীর দিকে দিকে শৃঙ্গাব্বনি বাজিয়া উঠিয়াছে, আমরা কি কেবল আমাদের উঠানের মাচার উপরকার লাউ কুমড়া লইয়া মকদ্দমা এবং আপীল চালাইতে থাকিব ! A. বহু বৎসর নীরব থাকিয়া বঙ্গদেশের প্রাণ ভরিয়া উঠিয়াছে। তাহাকে আপনার ভাষায় একবার আপনার কথাটি বলিতে দাও । বাঙালি-কণ্ঠের সহিত মিলিয়া বিশ্বসংগীত মধুরতর হইয়া উঠিবে। পৌষ ১২৯২ মা ভৈঃ মৃত্যু একটা প্ৰকাণ্ড কালো কঠিন কষ্টিপাথরের মতো । ইহারই গায়ে কষিয়া সংসারের সমস্ত খাটি সোনার পরীক্ষা হইয়া থাকে । তুমি দেশকে যথার্থ ভালোবাস, তাহার চরম পরীক্ষা তুমি দেশের জন্য মরিতে পার কি না। তুমি আপনাকে যথার্থ ভালোবাস, তাহারও চরম পরীক্ষা আপনার উন্নতির জন্য প্ৰাণ বিসর্জন করা তোমার পক্ষে সম্ভবপর কি না । এমন একটা বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন ভয় পৃথিবীর মাথার উপরে যদি না বুলিত, তবে সত্য-মিথাকে, ছোটাে-বড়ো-মাঝারিকে বিশুদ্ধভাবে তুলা করিয়া দেখিবার কোনো উপায় থাকিত না । এই মৃত্যুর তুলায় যে-সব জাতির তীেল হইয়া গেছে তাহারা পাস-মার্কা পাইয়াছে। তাহারা আপনাদিগকে প্রমাণ করিয়াছে, নিজের কাছে ও পরের কাছে তাহাদের আর কিছুতেই কুষ্ঠিত হইবার কোনো কারণ নাই। মৃত্যুর দ্বারাই তাঁহাদের জীবন পরীক্ষিত হইয়া গেছে। ধনীর যথার্থ পরীক্ষা দানে ; যাহার প্রাণ আছে তাহার যথার্থ পরীক্ষা প্ৰাণ দিবার শক্তিতে । যাহার প্রাণ নাই বলিলেই হয় সে-ই মরিতে কৃপণতা করে। যে মরিতে জানে সুখের অধিকার তাঁহারই ; যে জয় করে ভোগ করা তাহাকেই সাজে। যে লোক জীবনের সঙ্গে সুখকে বিলাসকে দুই হাতে আঁকড়িয়া থাকে, সুখ তাহার সেই ঘূণিত ক্রীতদাসের কাছে নিজের সমস্ত ভাণ্ডার খুলিয়া দেয় না ; তাহাকে উচ্ছিষ্টমাত্ৰ দিয়া দ্বারে ফেলিয়া রাখে। আর মৃত্যুর আহবানমাত্র যাহারা তুড়ি মারিয়া চলিয়া যায়, চির-আদৃত সুখের দিকে একবার পিছন ফিরিয়া তাকায় না, সুখ তাহাদিগকে চায়, সুখ তাহারাই জানে। যাহারা সবলে ত্যাগ করিতে পারে তাহারাই প্রবলভাবে ভোগ করিতে পারে। যাহারা মরিতে জানে না। তাহাদের ভোগবিলাসের দীনতা-কৃশতা-ঘূণ্যতা গাড়িজুড়ি এবং তকমা-চাপরাসের দ্বারা ঢাকা পড়ে না। ত্যাগের বিলাসবিরল কঠোরতার মধ্যে পৌরুষ আছে, যদি স্বেচ্ছায় তাহা বরণ করি তবে নিজেকে লজ্জা হইতে বঁাচাইতে পারিব । এই দুই রাস্তা আছে— এক ক্ষত্ৰিয়ের রাস্তা, আর-এক ব্ৰাহ্মণের রাস্তা। যাহারা মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে পৃথিবীর সুখসম্পদ তাঁহাদেরই। যাহারা জীবনের সুখকে অগ্রাহ্য করিতে পারে তাঁহাদের আনন্দ মুক্তির। এই দুয়েতেই পৌরুষ । “প্ৰাণটা দিব। এ কথা বলা যেমন শক্ত- ‘সুখটা চাই না। এ কথা বলা তাহা অপেক্ষা কম শক্ত নয়। পৃথিবীতে যদি মনুষ্যত্বের গৌরবে মাথা তুলিয়া চলিতে চাই তবে এই দুয়ের একটা কথা যেন বলিতে পারি। হয় বীর্যের সঙ্গে বলিতে হইবে চাই, নয় বীর্যেরই সঙ্গে বলিতে হইবে “চাই না’ । 'চাই বলিয়া কঁদিব, অথচ লইবার শক্তি নাই ; চাই না’ বলিয়া পড়িয়া থাকিব ; কারণ চাহিবার উদ্যম নাই— এমন ধিক্কার বহন করিয়াও যাহারা বঁাচে যম তাহাদিগকে নিজগুণে দয়া করিয়া না সরাইয়া লইলে তাহাদের মরণের আর উপায় নাই | বাঙালি আজকাল লোকসমাজে বাহির হইয়াছে। মুশকিল। এই যে, জগতের মৃত্যুশালা হইতে