পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্ৰ প্ৰবন্ধ ৬৭৫ তাহার কোনো পাস নাই। সুতরাং তাহার কথাবার্তা যতই বড়ো হােক, কাহারও কাছে সে খাতির দাবি করিতে পারে না। এইজন্য তাহার আস্ফালনের কথায় অত্যন্ত বেসুর এবং নাকিসুর লাগে। না মরিলে সেটার সংশোধন হওয়া শক্ত । পিতামহের বিরুদ্ধে আমাদের এইটেই সব চেয়ে বড়ো অভিযোগ । সেই তো আজ র্তাহারা নাই, তবে ভালোমন্দ কোনো-একটা অবসরে তাহারা রীতিমত মরিলেন না কেন ? তাহারা যদি মরিতেন তবে উত্তরাধিকারসূত্রে আমরাও নিজেদের মরিবার শক্তি সম্বন্ধে আস্থা রাখিতে পারিতাম। র্তাহারা নিজে না খাইয়াও ছেলেদের অন্নের, সংগতি রাখিয়া গেছেন, শুধু মৃত্যুর সংগতি রাখিয়া যান নাই। এত বড়ো দুৰ্ভাগ্য, এত বড়ো দীনতা আর কী হইতে পারে। ইংরেজ আমাদের দেশের যোদ্ধজাতিকে ডাকিয়া বলেন, “তোমরা লড়াই করিয়াছ, প্ৰাণ দিতে জান ; যাহারা কখনো লড়াই করে নাই, কেবল বকিতে জানে, তাহাদের দলে ভিডিয়া তোমরা কনগ্রেস করিতে যাইবে ।” তর্ক করিয়া ইহার উত্তর দেওয়া যাইতে পারে । কিন্তু তর্কের দ্বারা লজা যায় না । বিশ্বকর্ম নৈয়ায়িক ছিলেন না, সেইজন্য পৃথিবীতে অযৌক্তিক ব্যাপার পদে পদে দেখিতে পাওয়া যায়। সমানভাবে মিশিতে পারে না। যুক্তিশাস্ত্রে ইহা অসংগত, অর্থহীন, কিন্তু পৃথিবীতে ইহা সত্য। অতএব, আরাম-কেদারায় হেলান দিয়া পোলিটিকাল সুখস্বপ্নে যখন কল্পনা করি “সমস্ত ভারতবর্ষ। এক হইয়া মিশিয়া যাইতেছে, তখন মাঝখানে এই একটা দুশ্চিন্তা উঠে যে, বাঙালির সঙ্গে শিখ আপন ভাইয়ের মতো মিশিবে কেন ? বাঙালি বি. এ. এবং এম. এ. পরীক্ষায় পাস হইয়াছে বলিয়া ? কিন্তু যখন তাহার চেয়ে কড়া পরীক্ষার কথা উঠিবে তখন সাটিফিকেট বাহির করিব কোথা হইতে ? শুদ্ধমাত্র কথায় অনেক কাজ হয়, কিন্তু সকলেই জানেন চিড়ে ভিজাইবার সময় কথা দধির স্থান অধিকার করিতে পারে না ; তেমনি যেখানে রক্তের প্রয়োজন সেখানে বিশুদ্ধ কথা তাহার অভাব পূরণ করিতে অশক্ত । অথচ যখন ভাবিয়া দেখি আমাদের পিতামহীরা স্বামীর সহিত সহমরণে মরিয়াছেন, তখন আশা হয়— মর্যাটা তেমন কঠিন হইবে না। অবশ্য, তাহারা সকলেই স্বেচ্ছাপূর্বক মরেন নাই। কিন্তু অনেকেই যে মৃত্যুকে স্বেচ্ছাপূর্বক বরণ করিয়াছেন, বিদেশীরাও তাহার সাক্ষ্য দিয়াছেন। কোনো দেশেই লোকনির্বিশেষে নিৰ্ভয়ে ও স্বেচ্ছায় মরে না । কেবল স্বল্প এক দল মৃত্যুকে যথার্থভাবে বরণ করিতে পারে— বাকি সকলে কেহ বা দলে ভিড়িয়া মরে, কেহ বা লজ্জায় পড়িয়া মরে, কেহ বা দস্তুরের তাড়নায় জড়ভাবে মরে । মন হইতে ভয় একেবারে যায় না । কিন্তু ভয় পাইতে নিজের কাছে ও পরের কাছে লজা করা চাই । শিশুকাল হইতে ছেলেদের এমন শিক্ষা দেওয়া উচিত, যাহাতে ভয় পাইলেই তাহারা অনায়াসে অকপটে স্বীকার না করিতে পারে। এমন শিক্ষা পাইলে লোকে লজ্জায় পড়িয়া সাহস করে। যদি মিথ্যা গর্ব করিতে হয় তবে ‘আমার সাহস আছে। এই মিথ্যা গর্বই সব চেয়ে মার্জনীয়। কারণ, দৈন্যই বলো, অজ্ঞতাই বলো, মৃঢ়তাই বলো, মনুষ্যচরিত্রে ভয়ের মতো এত ছােটাে আর কিছুই নাই। ভয় নাই বলিয়া যে লোক মিথ্যা অহংকারও করে, অন্তত তাহার লজ্জা আছে। এ সদগুণটারও প্রমাণ হয় । নিভীকতা যেখানে নাই, সেখানে এই লজ্জার চর্চা করিলেও কাজে লাগে ৷ সাহসের ন্যায় লজ্জাও লোককে বল দেয়। লোকলজ্জায় প্রাণবিসর্জন করা কিছুই অসম্ভব নয়। অতএব আমাদের পিতামহীরা কেহ কেহ লোকলজ্জাতেও প্ৰাণ দিয়াছিলেন, এ কথা স্বীকার করা যাইতে পারে। প্ৰাণ দিবার শক্তি তীহাদের ছিল— লজ্জায় হােক, প্রেমে হােক, ধর্মোৎসাহে হােক, প্ৰাণ তাহারা দিয়াছিলেন, এ কথা আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে । বস্তুত দল বাধিয়া মরা সহজ । একাকিনী চিতাগ্নিতে আরোহণ করিবার মতো বীরত্ব যুদ্ধক্ষেত্রে বিরল ।