পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ°l\ე রবীন্দ্র-রচনাবলী বাংলার সেই প্ৰাণবিসর্জনপরায়ণা পিতামহীকে আজ আমরা প্ৰণাম করি। তিনি যে জাতিকে স্তন দিয়াছেন, স্বর্গে গিয়া তাহাকে বিস্মৃত হইবেন না। হে আর্যে তুমি তোমার সম্ভানদিগকে সংসারের চরম ভয় হইতে উত্তীর্ণ করিয়া দাও। তুমি কখনো স্বপ্নেও জান নাই যে, তোমার আত্মবিস্মৃত বীরত্ব-দ্বারা তুমি পৃথিবীর বীরপুরুষদিগকেও লজ্জিত করিতেছ। তুমি যেমন দিবাবসানে সংসারের কাজ শেষ করিয়া নিঃশব্দে পতির পালঙ্কে আরোহণ করিতে, দাম্পত্যলীলার অবসানদিনে সংসারের কার্যক্ষেত্র হইতে বিদায় লইয়া তুমি তেমনি সহজে বধুবেশে সীমান্তে মঙ্গল-সিন্দূর পরিয়া পতির চিতায় আরোহণ করিয়াছ। মৃত্যুকে তুমি সুন্দর করিয়াছ, শুভ করিয়াছ, পবিত্র করিয়াছ- চিতাকে তুমি বিবাহশয্যার ন্যায় আনন্দময় কল্যাণময় করিয়াছ। বাংলাদেশে পাবক তােমারই পবিত্র জীবনাহুতি দ্বারা পূত হইয়াছে— আজ হইতে এই কথা আমরা স্মরণ করিব। আমাদের ইতিহাস নীরব, কিন্তু অগ্নি আমাদের ঘরে ঘরে তোমার বাণী বহন করিতেছে। তোমার অক্ষয় অমর স্মরণনিলয় বলিয়া সেই অগ্নিকে, তোমার সেই অন্তিমবিবাহের জ্যোতিঃসূত্রময় অনন্ত পট্টবসনখানিকে, আমরা প্রত্যহ প্ৰণাম করিব। সেই অগ্নিশিখা তোমার উদ্যত বাহুরূপে আমাদের প্রত্যেককে আশীৰ্বাদ করুক। মৃত্যু যে কত সহজ, কত উজ্জ্বল, কত উন্নত, হে চিরনীরবস্বৰ্গবাসিনী, অগ্নি আমাদের গৃহপ্ৰাঙ্গণে তোমার নিকট হইতে সেই বার্তা বহন করিয়া অভয় ঘোষণা করুক । কীর্তিক ১৩০৯ পাগল পশ্চিমের একটি ছোটাে শহর। সম্মুখে বড়ো রাস্তার পরপ্রান্তে খোড়ো চালগুলার উপরে পাঁচ-ছয়টা তালগাছ বোবার ইঙ্গিতের মতো আকাশে উঠিয়াছে, এবং পোড়ো বাড়ির ধারে প্রাচীন তেঁতুলগাছ তাহার লঘুচিকণ ঘন পল্লবভার সবুজ মেঘের মতো ভূপে স্তুপে স্ফীত করিয়া রহিয়াছে। চালশূন্য ভাঙা ভিটার উপরে ছাগ-ছানা চরিতেছে। পশ্চাতে মধ্যাহ্ন-আকাশের দিগন্তরেখা পর্যন্ত বনশ্রেণীর *ठळऊ | আজ এই শহরটির মাথার উপর হইতে বর্ষ হঠাৎ তাহার কালো অবগুণ্ঠন একেবারে অপসারিত করিয়া দিয়াছে । আমার অনেক জরুরি লেখা পড়িয়া আছে- তাহারা পড়িয়াই রহিল। জানি, তাহা ভবিষ্যতে পরিতাপের কারণ হইবে ; তা হউক, সেটুকু স্বীকার করিয়া লইতে হইবে। পূর্ণতা কোন মূর্তি ধরিয়া হঠাৎ কখন আপনার আভাস দিয়া যায় তাহা তো আগে হইতে কেহ জানিয়া প্ৰস্তুত হইয়া থাকিতে পারে না, কিন্তু যখন সে দেখা দিল তখন তাহাকে শুধু হাতে অভ্যর্থনা করা যায় না। তখন লাভক্ষতির আলোচনা যে করিতে পারে সে খুব হিসাবি লোক সংসারে তাহার উন্নতি হইতে থাকিবে, কিন্তু হে নিবিড় আষাঢ়ের মাঝখানে একদিনের জ্যোর্তিময় অবকাশ, তোমার শুভ্ৰ-মেঘমাল্যখচিত ক্ষণিক অভ্যুদয়ের কাছে আমার সমস্ত জরুরি কাজ আমি মাটি করিলাম- আজ আমি ভবিষ্যতের হিসাব করিলাম না- আজ আমি বর্তমানের কাছে বিকাইলাম । দিনের পর দিন আসে, আমার কাছে তাহারা কিছুই দাবি করে না ; তখন হিসাবের অঙ্কে ভুল হয় না, তখন সকল কাজই সহজে করা যায় । জীবনটা তখন এক দিনের সঙ্গে আর-এক দিন, এক কাজের সঙ্গে আর-এক কাজ দিব্য গাথিয়া-গাথিয়া অগ্রসর হয় ; সমস্ত বেশ সমানভাবে চলিতে থাকে । কিন্তু হঠাৎ কোনাে খবর না দিয়া একটা বিশেষ দিন সাত-সমুদ্র-পারের রাজপুত্রের মতো আসিয়া উপস্থিত হয়, প্রতিদিনের সঙ্গে তাহার কোনো মিল হয় না, তখন মুহুর্তের মধ্যে এতদিনকার সমস্ত খেই হারাইয়া যায়- তখন বাধা কাজের পক্ষে বড়োই মুশকিল ঘটে। কিন্তু এই দিনই আমাদের বড়োদিন- এই অনিয়মের দিন, এই কাজ নষ্ট করিবার দিন । যে দিনটা আসিয়া আমাদের প্রতিদিনকে বিপর্যন্ত করিয়া দেয়। সেই দিন আমাদের আনন্দ । অন্য দিনগুলো