পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্ৰ প্ৰবন্ধ Webro) হতভাগা কাষ্ঠখণ্ডকে কে মাপ করিতে পারিত ? শকুন্তলা-নাটক বাহিরের চিত্রপটের কোনো অপেক্ষা রাখে নাই বলিয়া আপনার চিত্ৰপটগুলিকে আপনি সৃষ্টি করিয়া লইয়াছে। তাহার কথাশ্রম, তাহার স্বৰ্গপথের মেঘলোক, তাহার মারীচের তপােবনের জন্য সে আর-কাহারও উপর কোনাে বরাত দেয় নাই। সে নিজেকে নিজে সম্পূর্ণ করিয়া তুলিয়াছে। কি চরিত্রসৃজনে কি স্বভাবচিত্রে, নিজের কাব্যসম্পদের উপরেই তাহার একমাত্র নির্ভর। আমরা অন্য প্রবন্ধে বলিয়াছি, যুরোপীয়ের বাস্তব সত্য নহিলে নয়। কল্পনা যে কেবল তাঁহাদের চিত্তরঞ্জন করিবে তাহা নয়, কাল্পনিককে অবিকল বাস্তবিকের মতো করিয়া বালকের মতো তাহাদিগকে ভুলাইবে । কেবল কাব্যরসের প্রাণদায়িনী বিশল্যকরণী:টুকু হইলে চলিবে না, তাহার সঙ্গে বাস্তবিকতার আস্ত গন্ধমাদনটা পর্যন্ত চাই। এখন কলিযুগ, সুতরাং গন্ধমাদন টানিয়া আনিতে এঞ্জিনিয়ারিং চাইতাহার ব্যয়ও সামান্য নহে। বিলাতের স্টেজে শুদ্ধমাত্র এই খেলার জন্য যে বাজে খরচ হয়, ভারতবর্ষের কত অভ্ৰভেদী দুৰ্ভিক্ষ তাহার মধ্যে তলাইয়া যাইতে পারে। প্ৰাচ্যদেশের ক্রিয়াকর্ম খেলা-আনন্দ সমস্ত সরল-সহজ । কলাপাতায় আমাদের ভোজ সম্পন্ন হয় বলিয়া ভোজের যাহা প্রকৃততম আনন্দ, অর্থাৎ বিশ্বকে অবারিতভাবে নিজের ঘরটুকুর মধ্যে আমন্ত্রণ করিয়া আনা, সম্ভবপর হয় । আয়োজনের ভর যদি জটিল ও অতিরিক্ত হইত। তবে আসল জিনিসটাই মারা যাইত | বিলাতের নকলে আমরা যে থিয়েটার করিয়াছি তাহা ভারাক্রান্ত একটা স্ফীত পদার্থ। তাহাকে নড়ানো শক্ত, তাহাকে আপামর সকলের দ্বারের কাছে আনিয়া দেওয়া দুঃসাধ্য ; তাহাতে লক্ষ্মীর পেচাই সরস্বতী পদ্মকে প্রায় আচ্ছন্ন করিয়া আছে। তাহাতে কবি ও গুণীর প্রতিভার চেয়ে ধনীর মূলধন ঢের বেশি থাকা চাই। দর্শক যদি বিলাতি ছেলেমানুষিতে দীক্ষিত না হইয়া থাকে এবং অভিনেতার যদি নিজের প্রতি ও কাব্যের প্রতি যথার্থ বিশ্বাস থাকে, তবে অভিনয়ের চারি দিক হইতে তাহার বহুমূল্য বাজে জঞ্জালগুলো ঝাট দিয়া ফেলিয়া তাহাকে মুক্তিদান ও গৌরবদান করিলেই সহৃদয় হিন্দুসস্তানের মতো কাজ হয় । বাগানকে যে অবিকল বাগান আঁকিয়াই খাড়া করিতে হইবে এবং স্ত্রীচরিত্র অকৃত্রিম স্ত্রীলোককে দিয়াই অভিনয় করাইতে হইবে, এইরূপ অত্যন্ত স্থূল বিলাতি বর্বরতা মোটের উপরে বলা যাইতে পারে যে, জটিলতা অক্ষমতারই পরিচয় ; বাস্তবিকতা কাচপোকার মতো আর্টের মধ্যে প্রবেশ করিলে তেলাপোকার মতো তাহার অন্তরের সমস্ত রস নিঃশেষ করিয়া ফেলে, এবং যেখানে অজীর্ণবশত যথার্থ রসের ক্ষুধার অভাব সেখানে বহুমূল্য বাহা প্রাচুর্য ক্রমশই ভীষণরূপে বাড়িয়া চলে— অবশেষে অন্নকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করিয়া চাটনিই স্তুপাকার হইয়া উঠে । পৌষ ১৩০৯ কেক ধ্বনি হঠাৎ গৃহপালিত ময়ূরের ডাক শুনিয়া আমার বন্ধু বলিয়া উঠিলেন— আমি ঐ ময়ূরের ডাক সহ্য করিতে পারি না ; কবিরা কেকারবকে কেন যে তঁহাদের কাব্যে স্থান দিয়াছেন বুঝিবার জো নাই । কবি যখন বসন্তের কুহুস্বর এবং বর্ষার কেকা, দুটাকেই সমান আদর দিয়াছেন তখন হঠাৎ মনে হইতে পারে কবির বুঝি বা কৈবল্যদশাপ্ৰাপ্তি হইয়াছে— তাহার কাছে ভালো ও মন্দ, ললিত ও কর্কশের ভেদ লুপ্ত। কেবল কেকা কেন, ব্যাঙের ডাক এবং ঝিল্লির ঝংকারকে কেহ মধুর বলিতে পারে না। অথচ কবিরা এ শব্দগুলিকে উপেক্ষা করেন নাই। প্ৰেয়সীর কণ্ঠস্বরের সহিত ইহাদের তুলনা করিতে সাহস পান নাই, কিন্তু ষড়ঋতুর মহাসংগীতের প্রধান অঙ্গ বলিয়া তাহারা ইহাদিগকে সম্মান দিয়াছেন। এক প্রকারের মিষ্টতা আছে তাহা নিঃসংশয় মিষ্ট, নিতান্তই মিষ্ট । তাহা নিজের লালিত্য সপ্রমাণ