পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্ৰ প্ৰবন্ধ ܠܹܬܠ তাহার কবিত্ব উচ্চকাব্যশ্রেণীতে স্থায়ী হইতে পারে না। শেষের দিকে একটা কোথাও পৌঁছাইয়া দিতে হইবে, এই ভরসাতেই আমরা আমাদের চিরাভ্যন্ত সংসারের বাহির হইয়া কবির সহিত যাত্রা করি ; পুষ্পিত পথের মধ্য দিয়া আনিয়া হঠাৎ একটা শূন্যগহ্বরের ধারের কাছে ছাড়িয়া দিলে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়। এইজন্য কোনো কবির কাবা পড়িবার সময় আমরা এই দুটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি, তাহার পূর্বমেঘ আমাদিগকে কোথায় বাহির করে এবং উত্তরমেঘ কোন সিংহদ্বারের সম্মুখে আনিয়া উপনীত করে | さ* >○obr পরনিন্দা পরনিন্দা পৃথিবীতে এত প্রাচীন এবং এত ব্যাপক যে, সহসা ইহার বিরুদ্ধে একটা যে-সেমত প্রকাশ করা ধৃষ্টতা হইয়া পড়ে। নােনা জল পানের পক্ষে উপযোগী নহে। এ কথা শিশুও জানে— কিন্তু যখন দেখি সাত সমুদ্রের জল নুনে পরিপূর্ণ, যখন দেখি এই নোনা জল সমস্ত পৃথিবীকে বেড়িয়া আছে, তখন এ কথা বলিতে কোনােমতেই সাহস হয় না যে, সমুদ্রের জলে নুন না থাকিলেই ভালো হইত। নিশ্চয়ই ভালো হইত না, হয়তো লবণজলের অভাবে সমস্ত পৃথিবী পচিয়া উঠিত। তেমনি পরনিন্দ সমাজের কণায় কণায় যদি মিশিয়া না থাকিত তবে নিশ্চয়ই একটা বড়ো রকমের অনৰ্থ ঘটিত । উহা লবণের মতো সমস্ত সংসারকে বিকার হইতে রক্ষা করিতেছে। পাঠক বলিবেন, “বুঝিয়েছি! তুমি যাহা বলিতে চাও, তাহা অত্যন্ত পুরাতন । অর্থাৎ, নিন্দার ভয়ে সমাজ প্রকৃতিস্থ হইয়া আছে।” এ কথা যদি পুরাতন হয় তবে আনন্দের বিষয় । আমি তো বলিয়াছি, যাহা পুরাতন তাহা বিশ্বাসের যোগ্য । বস্তুত নিন্দ না থাকিলে পৃথিবীতে জীবনের গৌরব কী থাকিত ? একটা ভালো কাজে হাত দিলাম, তাহার নিন্দ কেহ করে না, সে ভালো কাজের দাম কী ! একটা ভালো কিছু লিখিলাম, তাহার নিন্দুক কেহ নাই, ভালো গ্রন্থের পক্ষে এমন মর্মান্তিক অনাদর কী হইতে পারে ! জীবনকে ধর্মচর্চায় উৎসর্গ করিলাম, যদি কোনো লোক তাহার মধ্যে গৃঢ় মন্দ অভিপ্রায় না দেখিল তবে সাধুতা যে নিতান্তই সহজ হইয়া পডিল । মহত্ত্বকে পদে পদে নিন্দার কাটা মাড়াইয়া চলিতে হয়। ইহাতে যে হার মানে বীরের সদগতি সে লাভ করে না । পৃথিবীতে নিন্দা দোষীকে সংশোধন করিবার জন্য আছে তাহা নহে, মহত্ত্বকে গীেরব দেওয়া তাহার একটা মস্ত কাজ । নিন্দা-বিরোধ গায়ে বাজে না, এমন কথা অল্প লোকই বলিতে পারে। কোনো সহৃদয় লোক তো বলিতে পারে না । যাহার হৃদয় বেশি তাহার ব্যথা পাইবার শক্তিও বেশি । যাহার হৃদয় আছে সংসারে সেই লোকই কাজের মতো কাজে হাত দেয় । আবার লোকের মতো লোক এবং কাজের মতো কাজ দেখিলেই নিন্দার ধার চারগুণ শাণিত হইয়া উঠে । ইহাতেই দেখা যায়, বিধাতা যেখানে অধিকার বেশি দিয়াছেন সেইখানেই দুঃখ এবং পরীক্ষা অত্যন্ত কঠিন করিয়াছেন। বিধাতার সেই বিধানই জয়ী হউক। নিন্দা দুঃখ বিরোধ যেন ভালো লোকের, গুণী লোকের ভাগেই বেশি করিয়া জোটে । যে - যথার্থক্কাপে ব্যথা ভোগ করিতে জানে সেই যেন ব্যথা পায়। অযোগ্য ক্ষুদ্র ব্যক্তির উপরে যেন নিন্দ-বেদনার অনাবশ্যক অপব্যয় না হয়। সরলহাদয় পাঠক পুনশ্চ বলিবেন, “জানি, নিন্দায় উপকার আছে। যে লোক দোষ করে তাহার দোষকে ঘোষণা করা ভালো ; কিন্তু যে করে না তাহার নিন্দায় সংসারে ভালো হইতেই পারে না । মিথ্যা জিনিসটা কোনো অবস্থাতেই ভালো নয়।”