পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্ৰ প্ৰবন্ধ \ტპა(č অবৈধ, কোন ঋতুতে আপিস কামাই না করা মহাপাতক, অরসিকের নিজবুদ্ধির উপর তাহা নির্ণয় করিবার ভার না দিয়া শাস্ত্রকারদের তাহা একেবারে বাধিয়া দেওয়া উচিত । বসন্তের দিনে-যে বিরহিণীর প্রাণ হা হা করে এ কথা আমরা প্রাচীন কাব্যেই পড়িয়াছি ; এখন এ কথা লিখিতে আমাদের সংকোচ বােধ হয়, পাছে লোকে হাসে। প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের মনের সম্পর্ক আমরা এমনি করিয়াই ছেদন করিয়াছি। বসন্তে সমস্ত বনে-উপবনে ফুল ফুটিবার সময় উপস্থিত হয় ; তখন তাহাদের প্রাণের অজস্রতা, বিকাশের উৎসব । তখন আত্মদানের উচ্ছাসে তরুলতা পাগল হইয়া উঠে ; তখন তাহাদের হিসাবের বােধমাত্র থাকে না— যেখানে দুটাে ফল ধরিবে সেখানে পঁচিশটা মুকুল ধরাইয়া বসে। মানুষই কি কেবল এই অজস্রতার স্রোত রোধ করিবে ? সে আপনাকে ফুটাইবে না, ফলাইবে না, দান করিতে চাহিবে না, কেবলই কি ঘর নিকাইবে, বাসন মজিবে ও যাহাদের সে বালাই নাই তাহারা বেলা চারটে পর্যন্ত পশমের গলাবন্ধ বুনিবে ? আমরা কি এতই একান্ত মানুষ ? আমরা কি বসন্তের নিগুঢ়-রসসঞ্চার-বিকশিত তরুলতাপুষ্পপল্লবের কেহই নাই ? তাহারা যে আমাদের এতই পর যে তাহারা যখন ফুলে ফুটিয়া উঠিবে আমরা তখন চাপকন পরিয়া আপিসে যাইব— কোনো অনির্বচনীয় বেদনায় আমাদের হৃৎপিণ্ড তরুপল্লবের মতো কঁপিয়া উঠিবে না ? আমি তো আজ গাছপালার সঙ্গে বহুপ্রাচীন কালের আত্মীয়তা স্বীকার করিব । ব্যস্ত হইয়া কাজ করিয়া বেড়ানােই যে জীবনের অদ্বিতীয় সার্থকতা এ কথা আজ আমি কিছুতেই মানিব না। আজ আমাদের সেই যুগান্তরের বড়েদিদি বনলক্ষ্মীর ঘরে ভাইফোটার নিমন্ত্রণ। সেখানে আজ তরুলতার আজ দুই হাত ছড়াইয়া আঁকড়াইয়া ধরিতে হইবে, বসন্তের হাওয়া যখন বহিবে তখন তাহার আনন্দকে যেন আমার বুকের পাজারগুলার মধ্য দিয়া অনায়াসে হু হু করিয়া বহিয়া যাইতে দিই— সেখানে সে যেন এমনতরো কোনো ধ্বনি না জাগাইয়া তোলে গাছপালারা যে ভাষা না বোঝে । এমনি করিয়া চৈত্রের শেষ পর্যন্ত মাটি বাতাস ও আকাশের মধ্যে জীবনটাকে কঁচা করিয়া, সবুজ করিয়া, ছড়াইয়া দিব— আলোতে ছায়াতে চুপ করিয়া পড়িয়া থাকিব । কিন্তু, হায়, কোনো কাজই বন্ধ হয় নাই ; হিসাবের খাতা সমানই খোলা রহিয়াছে। নিয়মের কলের মধ্যে, কর্মের ফাঁদের মধ্যে পড়িয়া গেছি, এখন বসন্ত আসিলেই কী আর গেলেই কী । মনুষ্যসমাজের কাছে আমার সবিনয় নিবেদন এই যে, এ অবস্থােটা ঠিক নহে, ইহার সংশোধন দরকার। বিশ্বের সহিত স্বতন্ত্র বলিয়াই যে মানুষের গৌরব তাহা নহে। মানুষের মধ্যে বিশ্বের সকল বৈচিত্ৰই আছে বলিয়া মানুষ বড়ো। মানুষ জড়ের সহিত জড়, তরুলতার সঙ্গে তরুলতা, মৃগপক্ষীর সঙ্গে মৃগপক্ষী। প্রকৃতি-রাজবাড়ির নানা মহলের নানা দরজাই তাহার কাছে খােলা। কিন্তু খােলা থাকিলে কী হইবে !! এক-এক ঋতুতে এক-এক মহল হইতে যখন উৎসবের নিমন্ত্রণ আসে তখন মানুষ যদি গ্রাহ্য না করিয়া আপন আড়াতের গদিতেই পড়িয়া থাকে, তবে এমন বৃহৎ অধিকার সে কেন পাইল ? পুরা মানুষ হইতে হইলে তাহাকে সবই হইতে হইবে, এ কথা না মনে করিয়া মানুষ মনুষ্যত্বকে বিশ্ববিদ্রোহের একটা সংকীর্ণ ধ্বজাস্বরূপ খাড়া করিয়া তুলিয়া রাখিয়াছে কেন ? কেন সে দম্ভ করিয়া বারবার এ কথা বলিতেছে- আমি জড় নহি, উদ্ভিদ নহি, পশু নহি, আমি মানুষ ; আমি কেবল কাজ করি ও সমালোচনা করি, শাসন করি ও বিদ্রোহ করি । কেন সে এ কথা বলে না- আমি সমস্তই সকলের সঙ্গেই আমার অবারিত যোগ আছে, স্বাতন্ত্র্যের ধ্বজা আমার নহে । হায় রে সমাজ-দৗড়ের পাখি, আকাশের নীল আজ বিরহিণীর চােখদুটির মতো স্বপ্নবিষ্ট, পাতার সবুজ আজ তরুণীর কপোলের মতো নবীন, বসন্তের বাতাস আজ মিলনের আগ্রহের মতো চঞ্চল, তবু তোর পাখা-দুটা আজ বন্ধ, তবু তোর পায়ে আজ কর্মের শিকল ঝন ঝন করিয়া রাজিতেছে এই কি ୪~~<ଅବ ! চৈত্র ১৩০৯