পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্ৰ প্ৰবন্ধ \ხპა 9 ছেলেরা যে একদিন এই ঘরের মধ্যে খেলা করিত, সেই কোলাহলময় দিন এই গৃহের নিশীথিনীর মধ্যে পড়িয়া আজ কঁদিতেছে। এই গৃহের মধ্যে যে-সকল স্নেহ-প্রেমের লীলা হইয়া গিয়াছে সেই স্নেহ-প্রেমের উপর সহসা কপাট পড়িয়া গেছে— এই নিস্তব্ধ গৃহের বাহিরে দাড়াইয়া আমি তাঁহাদের ক্ৰন্দন শুনিতেছি। স্নেহ-প্ৰেম বদ্ধ করিয়া রাখিবার জন্য হয় নাই। মানুষের কােছ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়া তাহাকে গোর দিয়া রাখিবার জন্য হয় নাই। তাহাকে জোর করিয়া বাধিয়া রাখিলে সংসারক্ষেত্রের জন্য সে কাদে । তবে এ গৃহ রুদ্ধ রাখিয়ে না, দ্বার খুলিয়া দাও । সূর্যের আলো দেখিয়া, মানুষের সাড়া পাইয়া, চকিত হইয়া ভয় প্রস্থান করিবে । সুখ এবং দুঃখ, শোক এবং উৎসব, জন্ম এবং মৃত্যু পবিত্র সমীরণের মতো ইহার বাতায়নের মধ্যে দিয়া চিরদিন যাতায়াত করিতে থাকিবে । সমস্ত জগতের সহিত ইহার যোগ হইয়া যাইবে । আশ্বিন-কার্তিক ১২৯২ 에37 আমি পথের ধারে বসিয়া লিখি, তাই কী লিখি ভাবিয়া পাই না | ছায়াময় পথ। প্রান্তে আমার ক্ষুদ্র গৃহ । তাহার বাতায়ন উন্মুক্ত | ভোরের বেলায় সূর্যের প্রথম কিরণ অশোকশাখার কম্পমান ছায়ার সঙ্গে আমার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়ায়, আমাকে দেখে, আমার কোলের উপর পাডিয়া খেলা করে, আমার লেখার উপর আসিয়া পড়ে এবং যখন চলিয়া যায় তখন লেখার উপরে খানিকটা সোনালি রঙ রাখিয়া দিয়া যায় ; আমার লেখার উপরে তাহার কনকচুম্বনের চিহ্ন থাকিয়া যায়। আমার লেখার চারি ধারে প্রভাত ফুটিয়া উঠে। মাঠের ফুল, মেঘের রঙ, ভোরের বাতাস এবং একটুখানি ঘুমের ঘোর আমার পাতার মধ্যে মিশাইয়া থাকে, অরুণের প্ৰেম আমার অক্ষরগুলির চারি দিকে লতাইয়া উঠে । আমার সমুখ দিয়া কত লোক আসে, কত লোক যায়। প্ৰভাতের আলো তাহাদের আশীর্বাদ করিতেছে, স্নেহভরে বলিতেছে “তোমাদের যাত্রা শুভ হউক’- পাখিরা কল্যাণগান করিতেছে, পথের বলিতেছে, “ভয় নাই, ভয় নাই।” প্ৰভাতে সমস্ত বিশ্বজগৎ শুভযাত্রার গান গাহিতেছে। অনন্ত নীলিমার উপর দিয়া সূর্যের জ্যোতির্ময় রথ ছুটিয়াছে। নিখিল চরাচর যেন এইমাত্র বিশ্বেশ্বরের জয়ধ্বনি করিয়া জগৎকে পথ দেখাইয়া দিতেছে। প্রভাত, জগতের আশা, আশ্বাস, প্রতিদিবসের নান্দী | প্রতিদিন সে পূর্বের কনকদ্বার উদঘাটন করিয়া জগতে স্বৰ্গ হইতে মঙ্গলবার্তা আনিয়া দেয়, সমস্ত দিনের মতো জাগাইয়া তোলে। প্ৰভাত জগতের যাত্রা আরম্ভের আশীর্বাদ ; সে আশীর্বাদ মিথ্যা নহে। আমার লেখার উপরে ছায়া ফেলিয়া পৃথিবীর লোক পথ দিয়া চলিয়া যাইতেছে। তাহারা সঙ্গে কিছুই লইয়া যায় না। তাহারা সুখ-দুঃখ ভুলিতে ভুলিতে চলিয়া যায়। জীবন হইতে প্রতি নিমেষের ভার ফেলিতে ফেলিতে চলিয়া যায়। তাঁহাদের হাসিকান্না আমার লেখার উপরে পড়িয়া অঙ্কুরিত হইয়া উঠে । তাঁহাদের গান তাহারা ভুলিয়া যায়, তাহাদের প্রেম তাহারা রাখিয়া যায়। আর-কিছুই থাকে না, কিন্তু প্রেম তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকে। তাহারা সমস্ত পথ কেবল ভালোবাসিতে-বাসিতে চলে। পথের যেখানেই তাহারা পা ফেলে সেইখানটুকুই তাহারা ভালোবাসে । সেইখানেই তাহারা চিহ্ন রাখিয়া যাইতে চায়- তাহাদের বিদায়ের অশ্রুজলে সে জায়গািটুকু উর্বরা হইয়া উঠে । তাঁহাদের পথের দুই পার্থে নূতন নূতন ফুল নূতন নূতন তারা ফুটিয়া থাকে। নূতন নূতন পথিকদিগকে তাহারা ভালোবাসিতে-বাসিতে অগ্রসর হয় । প্রেমের টানে তাহারা চলিয়া যায় ; প্রেমের