পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্ৰ প্ৰবন্ধ Voŵŵ) হইতে আর-একের দিকে অগ্রসর করিয়া দেয় | এইজন্যই তাহাকে পথের আলো বলি ; সে যদি আলেয়ার আলো হইত। তবে সে পথ ভুলইয়া ঘাড় ভাঙিয়া তোমাকে যা-হােক একটা-কিছুর মধ্যে ফেলিয়া দিত, আর-সমস্ত রুদ্ধ করিয়া দিত, সেই একটা-কিছুর মধ্যে পড়িয়াই তোমার অনন্তযাত্রার অবসান হইত— অন্য পথিকেরা তোমাকে মৃত বলিয়া চলিয়া যাইত। কিন্তু এখন সেটি হইবার জো নাই। একটিকে ভালোবাসিলেই আর-একটিকে ভালোবাসিতে শিখিবে ; অর্থাৎ এককে অতিক্রম করিবার উদ্দেশেই একের দিকে ধাবমান হইতে হইবে। পথ দেখাইবার জন্যই সকলে আসিয়াছে, পথের বাধা হইবার জন্য কেহ আসে নাই। এইজন্য কেহই ভিড় করিয়া তোমাকে ঘিরিয়া থাকে না, সকলেই সরিয়া গিয়া তোমাকে পথ করিয়া দেয়, সকলেই একে একে চলিয়া যায় । কেহই আপনাকে বা আর-কাহাকেও বদ্ধ করিয়া রাখিতে পারে না । ইচ্ছা করিয়া যে ব্যক্তি নিজের চারি দিকে দেয়াল গাথিয়া তোলে, কালের প্রবাহ ক্ৰমাগত আঘাত করিয়া তাহার সে দেয়াল একদিন ভাঙিয়া দেয়, তাহাকে পথের মধ্যে বাহির করিয়া দেয়। তখন সে আবরণের অভাবে হি-হি করিয়া কঁাপিতে থাকে, হায়-হায় করিয়া কাদিয়া মরে । জগৎকে দ্বিধা হইতে বলে । ধূলির মধ্যে আচ্ছন্ন হইবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। আমরা তো পথিক হইয়াই জন্মিয়ছি- অনন্ত শক্তিমান যদি এই অনন্ত পথের উপর দিয়া আমাদিগকে কেবলমাত্র বলপূর্বক লইয়া যাইতেন, প্রচণ্ড অদৃষ্ট যদি আমাদের চুলের মুঠি ধরিয়া হিড় শাসনের বজধ্বনি শুনিতেছি না, প্ৰভাতের আশ্বাসবাণী শুনিতেছি। পথের মধ্যে কষ্ট আছে, দুঃখ আছে । বটে, কিন্তু তবু আমরা ভালোবাসিয়া চলিতেছি। সকল সময়ে আমরা গ্রাহ্য করি না বটে, কিন্তু ভালোবাসা সহস্র দিক হইতে তাহার বাহু বাড়াইয়া আছে । সেই অবিশ্রাম ভালোবাসার আহবানই আমরা যেন শিরোধাৰ্য করিয়া চলিতে শিখি ; মোহে জড়াইয়া না পড়ি, অবশেষে অমোঘ শাসন আসিয়া আমাদিগকে যেন শৃঙ্খলে বাধিয়া না লইয়া যায়। আমি এই সহস্ৰ লোকের বিলাপ ও আনন্দধ্বনির ধারে বসিয়া আছি । আমি দেখিতেছি, ভাবিতেছি, ভালোবাসিতেছি । আমি পথিকদিগকে বলিতেছি, “তোমাদের যাত্রা শুভ হউক । আমি আমার প্ৰেম তোমাদিগকে পাথেয় স্বরূপে দিতেছি।' কারণ, পথ চলিতে আর-কিছুর আবশ্যক নাই, কেবল প্রেমের আবশ্যক । সকলে যেন সকলকে সেই প্ৰেম দেয় | পথিক যেন পথিককে পথ চলিতে সাহায্য করে । অগ্রহায়ণ। ১২৯২ ছোটােনাগপুর চেতনায় ঘুমে, স্বপ্নে জাগরণে খিচুড়ি পাকাইয়া যায়। মাঝে মাঝে আলোর শ্রেণী, ঘণ্টাধ্বনি, কোলাহল, বিচিত্র আওয়াজে স্টেশনের নাম হাঁক । আবার ঠং ঠং ঠং তিনটে ঘণ্টার শব্দে মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত অন্তহিঁত, সমস্ত অন্ধকার, সমস্ত নিস্তব্ধ, কেবল স্তিমিততারা নিশীথিনীর মধ্যে গাড়ির চাকার অবিশ্রাম শব্দ । সেই শব্দের তালে তালে মাথার ভিতরে সৃষ্টিছাড়া স্বপ্নের দল সমস্ত রাত্রি ধরিয়া নৃত্য করিতে থাকে। রাত চারটার সময় মধুপুর স্টেশনে গাড়ি বদল করিতে হইল। অন্ধকার মিলাইয়া আসিলে পর। প্ৰভাতের আলোকে গাড়ির জানলায় বসিয়া বাহিরে চাহিয়া দেখিলাম । গাড়ি অবিশ্রাম অগ্রসর হইতে লাগিল। ভাঙা মাঠের এক-এক জায়গায় শুষ্ক নদীর বালুকারেখা দেখা যায় ; সেই নদীর পথে বড়ো বড়ো কালো কালো পাথর পৃথিবীর কঙ্কালের মতো বাহির হইয়া পড়িয়াছে। মাঝে মাঝে এক-একটা মুণ্ডের মতো পাহাড় দেখা যাইতেছে। দূরের পাহাড়গুলি ঘন নীল, যেন আকাশের নীল মেঘ খেলা করিতে আসিয়া পৃথিবীতে ধরা পড়িয়ছে ; আকাশে উড়িবার জন্য যেন পাখা তুলিয়াছে, কিন্তু বাধা আছে বলিয়া উড়িতে পারিতেছে না ; আকাশ হইতে তাহার স্বজাতীয় V8G