পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্ৰ প্ৰবন্ধ °の○ নামাইয়া দিল। ছেলেদের প্রথমে উঠানো গেল, তাহার পর আমার ভাজ-ঠাকুরানী যখন বহুকষ্ট্রে তাহার স্থলপদ্ম-পা-দুখানি জাহাজের উপর তুলিলেন তখন আমরাও মধুকরের মতো তাহারই পশ্চাতে উপরে উঠিয়া পড়িলাম । ܔ যদিও স্রোত এবং বাতাস প্রতিকূলে ছিল, তথাপি আমাদের এই গজবর উর্ধর্বশুণ্ডে বৃংহিতধ্বনি করিতে করিতে গজেন্দ্রগমনের মনোহারিতা উপেক্ষা করিয়া চত্বারিংশৎতুরঙ্গ-বেগে ছুটিতে লাগিল । আমরা ছয়জন এবং জাহাজের বৃদ্ধ কর্তবাবু এই সাতজনে মিলিয়া জাহাজের কামরার সম্মুখে খানিকটা খোলা জায়গায় কেদারা লইয়া বসিলাম। আমাদের মাথার উপরে কেবল একটি ছাত আছে। সম্মুখ হইতে হু হু করিয়া বাতাস আসিয়া কনের কাছে সো সেঁা করিতে লাগিল, জামার মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাহাকে অকস্মাৎ ফুলাইয়া তুলিয়া ফর ফর আওয়াজ করিতে থাকিল এবং আমার ভ্রাতৃজায়ার সুদীর্ঘ সুসংযত চুলগুলিকে বার বার অবাধ্যতাচরণে উৎসাহিত করিয়া তুলিল। তাহারা নাকি জাত-সাপিনীর বংশ, এই নিমিত্ত বিদ্রোহী হইয়া বেণী-বন্ধন এড়াইয়া পূজনীয়া ঠাকুরানীর নাসাবিবর ও মুখরন্ধের মধ্যে পথ অনুসন্ধান করিতে লাগিল ; আবার আর-কতকগুলি উৰ্ধৰ্বমুখ হইয়া আস্ফালন করিতে করিতে মাথার উপর রীতিমত নাগলোকের উৎসব বাধাইয়া দিল ; কেবল বেণী-নামক অজগর সাপটা শত বন্ধনে বদ্ধ হইয়া, শত শেলে বিদ্ধ হইয়া, শত পাক পাকাইয়া নিজীবিভাবে খোপা আকারে ঘাড়ের কাছে কুণ্ডলী পাকাইয়া রহিল। অবশেষে কখন এক সময়ে দাদা কঁাধের দিকে মাথা নোয়াইয়া ঘুমাইতে লাগিলেন, বউঠাকুরানীও চুলের দৌরাত্ম্য বিস্মৃত হইয়া চৌকির উপরে চক্ষু মুদিলেন। জাহাজ অবিশ্রাম চলিতেছে। ঢেউগুলি চারি দিকে লাফাইয়া উঠিতেছে- তাহাদের মধ্যে এক-একটা সকলকে ছাড়াইয়া শুভ্র ফণা ধরিয়া হঠাৎ জাহাজের ডেকের উপর যেন ছোবল মারিতে আসিতেছে ; গর্জন করিতেছে, পশ্চাতের সঙ্গীদের মাথা তুলিয়া ডাকিতেছে ; স্পর্ধা করিয়া ফুলিয়া ফুলিয়া চলিতেছে- মাথার উপরে সূৰ্যকিরণ দীপ্তিমান চােখের মতো জ্বলিতেছে- নীেকাগুলাকে কত করিয়া ধরিয়া তাহার মধ্যে কী আছে দেখিবার জন্য উঁচু হইয়া দাড়াইয়া উঠিতেছে ; মুহুর্তের মধ্যে কীেতুহল পরিতৃপ্ত করিয়া নীেকাটাকে ঝাকানি দিয়া আবার কোথায় তাহারা চলিয়া যাইতেছে। আপিসের ছিপছিপে পানসিগুলি পালটুকু ফুলাইয়া আপনার মধুর গতির আনন্দ আপনি যেন উপভোগ করিতে করিতে চলিতেছে ; তাহারা মহৎ মাস্তুল-কিরিটী জাহাজের গান্তীৰ্য উপেক্ষা করে, স্টীমারের বিষাণধ্বনিও মান্য করে না, বরঞ্চ বড়ো বড়ো জাহাজের মুখের উপর পাল দুলাইয়া হাসিয়া রঙ্গ করিয়া চলিয়া যায় ; জাহাজও তাহাতে বড়ো অপমান জ্ঞান করে না। কিন্তু গাধাবােটের ব্যবহার স্বতন্ত্র, তাহাদের নড়িতে তিন ঘণ্টা, তাহাদের চেহারাটা নিতান্ত স্থূলবুদ্ধির মতো, তাহারা নিজে নড়িতে অসমৰ্থ ইয়া অবশেষে জাহাজকে সরিতে বলে— তাহারা গায়ের কাছে আসিয়া পড়িলে সেই স্পর্ধ অসহ্য বোধ হয় । এক সময় শুনা গেল আমাদের জাহাজের কাপ্তেন নাই। জাহাজ ছাড়িবার পূর্ব-রাত্রেই সে গা-ঢাকা দিয়াছে শুনিয়া আমার ভাজ-ঠাকুরানীর ঘুমের ঘোর একেবারে ছাড়িয়া গেল ; তাহার সহসা মনে হইল যে, কাপ্তেন যখন নাই তখন নোঙরের অচল-শারণ অবলম্বন করাই শ্ৰেয় । দাদা বলিলেন, তাহার আবশ্যক নাই, কাপ্তেনের নীচেকার লোকেরা কাপ্তেনের চেয়ে কোনাে অংশে নতুন নহে। কর্তবাবুরও সেইরূপ মত। বাকি সকলে চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু তাহাদের মনের ভিতরটা আর কিছুতেই প্ৰসন্ন হইল না। তবে, দেখিলাম নাকি জাহাজটা সত্য সত্যই চলিতেছে, আর হ্যাকডাকেও কাপ্তেনের অভাব সম্পূর্ণ ঢাকা পড়িয়াছে, তাই চুপ মারিয়া রহিলাম। হঠাৎ জাহাজের হৃদয়ের ধূক ধূক শব্দ বন্ধ হইয়া গৈল ! কল চলিতেছে না ! ‘নোঙর ফেলো ‘নোঙর ফেলো’ বলিয়া শব্দ উঠিল— নোঙর ফেলা হইল। কলের এক জায়গায় কোথায় একটা জোড় খুলিয়া গেছে, সেটা মেরামত করিলে তবে জাহাজ