পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রাচীন সাহিত্য AS (ł যে জাতি খণ্ডসত্যকে প্রাধান্য দেন, র্যাহারা বাস্তবসত্যের অনুসরণে ক্লান্তি বোধ করেন না, কাব্যকে যাহারা প্রকৃতির দর্পণমাত্র বলেন, তাহারা জগতে অনেক কাজ কবিতেছেন ; তঁহারা বিশেষভাবে ধন্য হইয়াছেন ; মানবজাতি তীহাদের কাছে ঋণী। অন্য দিকে, র্যাহারা বলিয়াছেন। ‘ভূমৈব সুখং ভূমীত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ, র্যাহারা পরিপূর্ণ পরিণামের মধ্যে সমস্ত খণ্ডতার সুষম— সমস্ত বিরোধের শান্তিউপলব্ধি করিবার জন্য সাধনা করিয়াছেন, তাহাদেরও ঋণ কোনো কালে পরিশোধ হইবার নহে। তাহাদের পরিচয় বিলুপ্ত হইলে, তাহাদের উপদেশ বিস্মৃত হইলে, মানবসভ্যতা আপন ধূলিধূমসমাকীর্ণ কারখানাঘরের জনতা-মধ্যে নিশ্বাসকলুষিত বদ্ধ আকাশে পলে পলে পীড়িত হইয়া কৃশ হইয়া মরিতে থাকিবে । রামায়ণ সেই অখণ্ড-অমৃত-পিপাসুদেরই চিরপরিচয় বহন করিতেছে। ইহাতে যে সৌভ্রাত্র, যে সত্যপরতা, যে পতিব্ৰত্য, যে প্রভৃভক্তি বর্ণিত হইয়াছে, তাহার প্রতি যদি সরল শ্রদ্ধা ও অন্তরের ভক্তি রক্ষা করিতে পারি। তবে আমাদের কারখানাঘরের বাতায়ন-মধ্যে মহাসমুদ্রের নির্মল বায়ু প্রবেশের পথ পাইবে । ব্ৰহ্মচর্যাশ্রম | বোলপুর ৫ পৌষ ১৩১০ রামগিরি হইতে হিমালয় পর্যন্ত প্রাচীন ভারতবর্ষের যে দীর্ঘ এক খণ্ডের মধ্য দিয়া মেঘদূতের মন্দাক্রান্ত ছন্দে জীবনস্রোত প্রবাহিত হইয়া গিয়াছে, সেখান হইতে কেবল বর্ষাকাল নহে, চিরকালের মতো আমরা নির্বাসিত হইয়াছি। সেই যেখানকার উপবনে কেতকীর বেড়া ছিল, এবং বর্ষার প্রাক্কালে গ্ৰামচৈতো গৃহবলিভূক পাখিরা নীড় আরম্ভ করিতে মহাব্যস্ত হইয়া উঠিয়ছিল, এবং গ্রামের প্রান্তে জম্বুবনে ফল পাকিয়া মেঘের মতো কালো হইয়াছিল, সেই দশার্ণ কোথায় গেল !! আর, সেই- যে অবন্তীতে গ্রামবুদ্ধের উদয়ন এবং বাসবদত্তার গল্প বলিত, তাহারাই বা কোথায় ! আর, সেই সিপ্রতটবর্তিনী উজ্জয়িনী ! অবশ্য তাহার বিপুল শ্ৰী, বহুল ঐশ্বৰ্য ছিল, কিন্তু তাহার বিস্তারিত বিবরণে আমাদের স্মৃতি ভারাক্রান্ত নহে— আমরা কেবল সেই- যে হর্ম্যবাতায়ন হইতে পুরবধূদিগের কেশসংস্কারধূপ উড়িয়া আসিতেছিল তাঁহারই একটু গন্ধ পাইতেছি, এবং অন্ধকার রাত্রে যখন ভবনশিখরের উপর পারাবতগুলি ঘুমাইয়া থাকিত তখন বিশাল জনপূর্ণ নগরীর পরিত্যক্ত পথ এবং প্রকাণ্ড সুষুপ্তি মনের মধ্যে অনুভব করিতেছি, এবং সেই রুদ্ধদ্বার সুপ্তসৌধ রাজধানীর নির্জন পথের অন্ধকার দিয়া কম্পিতহাদয়ে ব্যাকুলচরণক্ষেপে যে অভিসারিণী চলিয়াছে তাহারই একটুখানি ছায়ার মতো দেখিতেছি, এবং ইচ্ছা করিতেছে তাহার পায়ের কাছে নিকষে কনকরেখার মতো যদি আমনি একটুখানি আলো করিতে পারা যায় । আবার সেই প্রাচীন ভারতখণ্ডটুকুর নদী-গিরি-নগরীর নামগুলিই বা কী সুন্দর !! অবন্তী বিদিশা উজ্জয়িনী, বিন্ধ কৈলাস দেবগিরি, রেবা সিপ্রা বেত্ৰবতী । নামগুলির মধ্যে একটি শোভা সম্রম শুভ্রতা আছে । সময় যেন তখনকার পর হইতে ক্ৰমে ক্ৰমে ইতর হইয়া আসিয়াছে, তাহার ভাষা ব্যবহার মনোবৃত্তির যেন জীৰ্ণতা এবং অপভ্রংশত ঘটিয়াছে। এখনকার নামকরণও সেই অনুযায়ী | মনে হয়, ঐ রেবা-সিপ্রা-নির্বিন্ধ্যা নদীর তীরে অবন্তী-বিদিশার মধ্যে প্রবেশ করিবার কোনো পথ যদি থাকিত তবে এখনকার চারি দিকের ইতর কলকাকলি হইতে পরিত্রাণ পাওয়া যাইত । অতএব, যক্ষের যে মেঘ নগনদীনগরীর উপর দিয়া উড়িয়া চলিয়াছে, পাঠকের বিরহকাতরতার দীর্ঘনিশ্বাস তাহার সহচর হইয়াছে। সেই কবির ভারতবর্ষ যেখানকার জনপদবধুদিগের প্রীতিস্নিগ্ধলোচন ভূবিকার শিখে নাই এবং পুরবধুদিগের ভুলতাবিভ্ৰমে-পরিচিত নিবিড়পক্ষ্ম কৃষ্ণনেত্ৰ হইতে কৌতুহলদৃষ্টি মধুকরশ্রেণীর মতো উর্ধের্ব উৎক্ষিপ্ত হইতেছে, সেখান হইতে আমরা বিচ্যুত হইয়াছি— এখন কবির মেঘ ছাড়া সেখানে আর কাহাকেও দূত পঠাইতে পারি না। VO|| || 8 N2