পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ASV) রবীন্দ্র-রচনাবলী মনে পড়িতেছে কোনাে ইংরেজ কবি লিখিয়াছেন, মানুষেরা এক-একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতে, পরস্পরের মধ্যে অপরিমেয় অশ্রুলবণাক্ত সমুদ্র। দূর হইতে যখনই পরস্পরের দিকে চাহিয়া দেখি, মনে হয়, এক কালে আমরা এক মহাদেশ ছিলাম, এখন কাহার অভিশাপে মধ্যে বিচ্ছেদের বিলাপরাশি ফেনিল হইয়া উঠিতেছে। আমাদের এই সমুদ্রবেষ্টিত ক্ষুদ্র বর্তমান হইতে যখন কাব্যবর্ণিত সেই অতীত ভূখণ্ডের তািটর দিকে চাহিয়া দেখি তখন মনে হয়, সেই সিপ্রতীরের যুথীবনে যে পুস্পলবী রমণীরা ফুল তুলিত, অবন্তীর নগর চত্বরে যে বৃদ্ধগণ উদয়নের গল্প বলিত, এবং আষাঢ়ের প্রথম মেঘ দেখিয়া যে প্রবাসীরা আপন আপন পথিকবধুর জন্য বিরহব্যাকুল হইত, তাহাদের এবং আমাদের মধ্যে যেন সংযোগ থাকা উচিত ছিল। আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্বের নিবিড় ঐক্য আছে, অথচ কালের নিষ্ঠুর ব্যবধান। কবির কল্যাণে এখন সেই অতীতকাল অমর সৌন্দর্যের অলকাপুরীতে পরিণত হইয়াছে ; মুক্ত আমাদের বিবিেচ্ছ। এই বর্তমান মর্ডলেক হঁতে সেখােন কল্পকার মন্দ্ৰত প্রেল কিন্তু কেবল অতীত বর্তমান নহে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অতলস্পর্শ বিরহ । আমরা যাহার সহিত মিলিত হইতে চাহি সে আপনার মানসসরোবরের অগম তীরে বাস করিতেছে ; সেখানে কেবল কল্পনাকে পাঠানো যায়, সেখানে সশরীরে উপনীত হইবার কোনো পথ নাই। আমিই বা কোথায় আর তুমিই বা কোথায় । মাঝখানে একেবারে অনন্ত । কে তাহা উত্তীর্ণ হইবে ! অনন্তের কেন্দ্ৰবতী সেই প্রিয়তম অবিনশ্বর মানুষটির সাক্ষাৎ কে লাভ করিবে ! আজি কেবল ভাষায়-ভাবে আভাসে-ইঙ্গিতে ভুল-ভ্ৰান্তিতে আলো-আঁধারে দেহে-মনে জন্মমৃত্যুর দ্রুততর স্রোতেবেগের মধ্যে, তাহার একটুখানি বাতাস পাওয়া যায় মাত্র । যদি তোমার কাছ হইতে একটা দক্ষিণের হাওয়া আমার কাছে আসিয়া পৌছে তবে সেই আমার বহুভাগ্য, তাহার অধিক এই বিরহলোকে কেহই আশা করিতে পারে না | পূর্বং স্পষ্টং যদি কিল ভ VYKÖ(KVO) || এই চিরবিরহের কথা উল্লেখ করিয়া বৈষ্ণব কবি গাহিয়াছেনদুহু কোলে দুহু কঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া । আমরা প্রত্যেকে নির্জন গিরিশৃঙ্গে একাকী দণ্ডায়মান হইয়া উত্তরমুখে চাহিয়া আছি ; মাঝখানে আকাশ এবং মেঘ এবং সুন্দরী পৃথিবীর রেবা সিপ্রা অবন্তী উজ্জয়িনী, সুখ সৌন্দৰ্য-ভোগ-ঐশ্বর্যের চিত্ৰলেখা— যাহাতে মনে করাইয়া দেয়, কাছে আসিতে দেয় না— আকাঙক্ষার উদ্রেক করে, নিবৃত্তি করে না। দুটি মানুষের মধ্যে এতটা দূর ! কিন্তু এ কথা মনে হয়, আমরা যেন কোনাে-এক কালে একত্র এক মানসলোকে ছিলাম, সেখান হইতে নির্বাসিত হইয়াছি। তাই বৈষ্ণব কবি বলেন ; তোমায় হিয়ার ভিতর হইতে কে কৈল বাহির ! এ কী হইল ! যে আমার মনোরাজ্যের লোক, সে আজ বাহিরে আসিল কেন ! ওখানে তো তোমার স্থান নয় । বলরামদাস বলিতেছেন : তেঁই বলরামের, পহু, চিত নহে স্থির । যাহারা একটি সর্বব্যাপী মনের মধ্যে এক হইয়া ছিল তাহারা আজ সব বাহির হইয়া পড়িয়াছে। তাই পরস্পরকে দেখিয়া চিত্ত স্থির হইতে পারিতেছে না ; বিরহে বিধুর, বাসনায় ব্যাকুল হইয়া পড়িতেছে। আবার হৃদয়ের মধ্যে এক হইবার চেষ্টা করিতেছি, কিন্তু মাঝখানে বৃহৎ পৃথিবী। হে নির্জন গিরিশিখরের বিরহী, স্বপ্নে যাহাকে আলিঙ্গন করিতেছ, মেঘের মুখে যাহাকে সংবাদ পঠাইতেছ, কে তোমাকে আশ্বাস দিল যে, এক অপূর্ব সৌন্দর্যলোকে শরৎপূর্ণিমারাত্রে তাহার সহিত চিরমিলন হইবে ? তোমার তো চেতন-অচেতনে পার্থক্যজ্ঞান নাই, কী জানি যদি সত্য ও কল্পনার মধ্যেও প্ৰভেদ হারাইয়া থাক । অগ্রহায়ণ। ১২৯৮