পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

A Sbr রবীন্দ্র-রচনাবলী কালিদাস অনাহূত প্রেমের সেই উন্মত্ত সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করেন নাই, তাহাকে তরুণলাবণের উজ্জ্বল রঙেই আঁকিয়া তুলিয়াছেন। কিন্তু এই অত্যুজ্জ্বলতার মধ্যেই তিনি তাহার কাব্যকে শেষ করেন নাই। যে প্রশান্ত বিরলবর্ণ পরিণামের দিকে তিনি কাব্যকে লইয়া গিয়াছেন, সেইখানেই তাহার কাব্যের চরম কথা । মহাভারতের সমস্ত কর্ম যেন মহাপ্রস্থানে শেষ হইয়াছে, তেমনি কুমারসম্ভবের সমস্ত প্রেমের বেগ মঙ্গল-মিলনেই পরিসমাপ্ত | কুমারসম্ভব এবং শকুন্তলাকে একত্র তুলনা না করিয়া থাকা যায় না। দুটিরই কাব্যবিষয় নিগৃঢ়ভাবে এক । দুই কাব্যেই মদন যে মিলন সংসাধন করিতে চেষ্টা করিয়াছে তাহাতে দৈবশাপ লাগিয়াছে, সে মিলন অসম্পন্ন অসম্পূর্ণ হইয়া আপনার বিচিত্রকারুখচিত পরমসুন্দর বাসরশয্যার মধ্যে দৈবাহত হইয়া মরিয়াছে। তাহার পরে কঠিন দুঃখ ও দুঃসহ বিরহব্ৰত -দ্বারা যে মিলন সম্পন্ন হইয়াছে তাহার প্রকৃতি অন্যরূপ— তাহা সৌন্দর্যের সমস্ত বাহ্যাবরণ পরিত্যাগ করিয়া বিরলনির্মল বেশে কল্যাণের শুভ্ৰদীপ্তিতে কমনীয় হইয়া উঠিয়াছে। স্পর্ধিত মদন যে মিলনের কর্তৃত্বভার লইয়াছিল তাহার আয়োজন প্রচুর । সমাজ-বেষ্টনের বাহিরে দুই তপোবনের মধ্যে অহেতুক আকস্মিক নবপ্রেমকে কবি যেমন কৌশলে তেমনি সমারোহে সুন্দর অবকাশ দান করিয়াছেন । যতি কৃত্তিবাস তখন হিমালয়ের প্রস্থে বসিয়া তপস্যা করিতেছিলেন । শীতল বায়ু মৃগনাভির গন্ধ ও কিন্নরের গীতধ্বনি বহন করিয়া গঙ্গাপ্রবাহসিঞ্চিত দেবদারুশ্রেণীকে আন্দোলিত করিতেছিল ; সেখানে হঠাৎ অকালবসন্তের সমাগম হইতেই দক্ষিণদিগবধূ সদ্যঃপুষ্পিত অশোকের নবপল্লবজাল মৰ্মরিত করিয়া আতপ্ত দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। ভ্রমরযুগল এক কুসুমপাত্রে মধু খাইতে লাগিল এবং কৃষ্ণসার মৃগ স্পৰ্শ-নিমীলিতাক্ষী হরিণীর গাত্ৰ শৃঙ্গদ্বারা ঘর্ষণ করিল। তপোবনে বসন্তসমাগম ! তপস্যার সুকঠোর নিয়মসংযমের কঠিন বেষ্টন-মধ্যে হঠাৎ প্রকৃতির আত্মস্বরূপবিস্তার ! প্ৰমোদবনের মধ্যে বসন্তের বাসন্তিকতা এমন আশ্চর্যরূপে দেখা দেয় না । মহর্ষি কন্ধের মালিনীতীরবর্তী আশ্রমেও এইরূপ । সেখানে হুত হােমের ধূমে তপোবনতরুর পল্লব-সকল বিবৰ্ণ, সেখানে জলাশয়ের পথ-সকল মুনিদের সিক্তবন্ধলক্ষরিত জলরেখায় অঙ্কিত এবং সেখানে বিশ্বস্ত মৃগ-সকল রথচক্ৰধ্বনি ও জ্যানিঘোষকে নিৰ্ভয় কৌতুহলের সহিত শুনিতেছে। কিন্তু সেখান হইতেও প্রকৃতি দূরে পলায়ন করে নাই, সেখানেও কখন রুক্ষ বন্ধলের নীচে হইতে শকুন্তলাব নবযৌবন অলক্ষ্যে উদভিন্ন হইয়া দৃঢ়পিনদ্ধ বন্ধনকে চারি দিক হইতে ঠেলিতেছিল। সেখানেও বায়ুকম্পিত পল্লবাঙ্গুলি-দ্বারা চুতবৃক্ষ যে সংকেত করে তাহা সামমন্ত্রের সম্পূর্ণ অনুগত নহে এবং নবকুসুমযৌবনা নবমালিকা সহকার তরুকে বেষ্টন করিয়া প্রিয়মিলনের ঔৎসুক্য প্রচার করে । চারি দিকে অকালবসন্তের অজস্র সমারোহ, তাহারই মাঝখানে গিরিরাজনন্দিনী কী মোহনবেশেই দেখা দিলেন। অশোককণিকারের পুষ্পভূষণে তিনি সজ্জিতা, অঙ্গে বালারুণবর্ণের বসন, কেসরমালার কাঞ্চী পুনঃপুনঃ স্রস্ত হইয়া পড়িতেছে, আর ভয়চঞ্চললোচনা গৌরী ক্ষণে ক্ষণে লীলাপদ্ম সঞ্চালন করিয়া দুরন্ত ভ্ৰমরগণকে নিবারণ করিতেছেন। অন্য দিকে দেবদারুদ্রুমবেদিকার উপরে শার্দুলচর্মাসনে ধূর্জটি ভুজঙ্গপাশবদ্ধ জটাকলাপ এবং গ্ৰন্থিযুক্ত কৃষ্ণমৃগচর্ম ধারণ করিয়া ধ্যানস্তিমিতলোচনে অনুত্তরঙ্গ সমুদ্রের মতো আপনাকে আপনি নিরীক্ষণ করিতেছিলেন । অস্থানে অকালবসন্তে মদন এই দুই বিসদৃশ পুরুষ-রমণীর মধ্যে মিলনসাধনের জন্য উদ্যত ছিলেন । কশ্বাশ্রমেও সেইরূপ । কোথায় বন্ধলবসন তাপসকন্যা এবং কোথায় সসাগরা ধরণীর চক্রবর্তী অধীশ্বর ! দেশ কাল পাত্রকে মুহূর্তের মধ্যে এমন করিয়া যে বিপর্যন্ত করিয়া দেয়, সেই মীনকেতনের যে কী শক্তি কালিদাস তাহা দেখাইয়াছেন । কিন্তু কবি সেইখনেই থামেন নাই। এই শক্তির কাছেই তিনি তাহার কাব্যের সমস্ত রাজকর