পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१२२ রবীন্দ্র-রচনাবলী নবপুষ্পিতা বনতোষিণী, সীেরভভ্রান্ত মূঢ় ভ্রমর এবং তরু-অন্তরালবতী মুগ্ধ রাজা তপোবনের একটি নিভৃত প্রান্ত আশ্রয় করিয়া সৌন্দর্যমন্দমােদিত এক অপরূপ দৃশ্য উদঘাটিত করিয়াছে। এই প্রমোদস্বর্গ হইতে দুষ্মন্তপ্ৰেয়সী অপমানে নির্বাসিত হইয়া গিয়াছেন, কিন্তু কল্যাণীরূপিণী ভরতজননী যে দিব্যতরা তপােভূমিতে আশ্রয় লইয়াছেন সেখানকার দৃশ্য অন্যরূপ। সেখানে কিশোরী তাপসকন্যারা আলবালে জল সেচন করিতেছে না, লতাভগিনীকে মেহদৃষ্টি-দ্বারা অভিষিক্ত করিতেছে না, কৃতকপুত্ৰ মৃগশিশুকে নীবারমুষ্টি-দ্বারা পালন করিতেছে না । সেখানে তরুলতাপুষ্পপল্লবের সমুদয় চাঞ্চল্য একটিমাত্র বালক অধিকার করিয়া বসিয়া আছে, সমস্ত বনভূমির কোল সে ভরিয়া রহিয়াছে ; সেখানে সহকারশাখায় মুকুল ধরে কি না, নবমল্লিকার পুষ্পমঞ্জরী ফোটে কি না, সে কাহারও চক্ষেও পড়ে না। মেহব্যাকুল তাপসী মাতারা দুরন্ত বালকটিকে লইয়া ব্যস্ত হইয়া রহিয়াছেন। প্রথম অঙ্কে শকুন্তলার সহিত পরিচয় হইবার পূর্বে দূর হইতে তাহার নবযৌবনের লাবণ্যলীলা দুষ্মন্তকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করিয়ছিল। শেষ অঙ্কে শকুন্তলার বালকটি শকুন্তলার সমস্ত লাবণ্যের স্থান অধিকার করিয়া লইয়া রাজার অন্তরতম হৃদয় আদ্ৰ করিয়া দিল । an N বসনে পরিধূসারে বসানা নিয়মক্ষমমুখী ধূতৈকবেণিঃ মলিন ধূসরবসনা, নিম্নমচর্যায় শুল্কমুখী, একবেণীধরা, বিরহব্ৰতচারিণী, শুদ্ধশীলা শকুন্তলা প্রবেশ করিলেন। এমন তপস্যার পরে অক্ষয়বরলাভ হইবে না ? সুদীৰ্ঘব্রতচারণে প্রথম সমাগমের গ্লানি দগ্ধ হইয়া, পুত্ৰশোভায় পরমভূষিতা যে করুণকল্যাণচ্ছবি জননীমূর্তি বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে তাহাকে কে প্রত্যাখ্যান করিবে ? ধূর্জটির মধ্যে গীেরী কোনাে অভাব, কোনাে দৈন্য দেখিতে পান নাই। তিনি তীহাকে ভাবের চক্ষে দেখিয়ছিলেন, সে দৃষ্টিতে ধনরত্ব-রূপযৌবনের কোনো হিসাব ছিল না। শকুন্তলার প্ৰেম সুতীব্র অপমানের পরেও মিলনকালে দুষ্মন্তের কোনাে অপরাধই লইল না, দুঃখিনীর দুই চক্ষু দিয়া কেবল জল পড়িতে লাগিল। যেখানে প্রেম নাই সেখানে অভাবের, দৈন্যের, কুরূপের সীমা নাই— যেখানে প্রেম নাই সেখানে পদে পদে অপরাধ। গৌরীর প্ৰেম যেমন নিজের সৌন্দর্যে সম্পদে সন্ন্যাসীকে সুন্দর ও ঈশ্বর করিয়া দেখিয়াছিল, শকুন্তলার প্রেমও সেইরূপ নিজের মঙ্গলদৃষ্টিতে দুষ্মন্তের সমস্ত অপরাধকে দূর করিয়া দেখিয়ছিল। যুবক-যুবতীর মোহমুগ্ধ প্রেমে এত ক্ষমা কোথায় ? ভরতজননী যেমন পুত্রকে জঠরে ধারণ করিয়াছিলেন, সহিষ্ণুতাময়ী ক্ষমাকেও তেমনি শকুন্তলা তপোবনে বসিয়া আপনার অন্তরের মধ্যে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিয়াছিলেন। বালক ভরত দুষ্মন্তকে দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, 'মা, এ কে আমাকে পুত্র বলিতেছে ? শকুন্তলা উত্তর করিলেন, "বাছা, আপনার ভাগ্যকে জিজ্ঞাসা করে | ইহার মধ্যে অভিমান ছিল না ; ইহার অর্থ এই যে, “যদি ভাগ্য প্রসন্ন হয় তবে ইহার উত্তর পাইবে”— বলিয়া রাজার প্রসন্নতার অপেক্ষা করিয়া রহিলেন । যেই বুঝিলেন দুষ্মন্ত তাহাকে অস্বীকার করিতেছেন না তখনই নিরভিমানা নারী বিগলিত চিত্তকে দুষ্মন্তের চরণে পূজাঞ্জলি দান করিলেন, নিজের ভাগ্য ছাড়া আর-কাহারও কোনো অপরাধ দেখিতে পাইলেন না। আত্মাভিমানের দ্বারা অনাকে খণ্ডিত করিয়া দেখিলে তাহার দোষত্রুটি বড়ো হইয়া উঠে ; ভাবের দ্বারা, প্রেমের দ্বারা সম্পূর্ণ করিয়া দেখিলে সে-সমস্ত কোথায় অদৃশ্য হইয়া যায়। যেমন শ্লোকের এক চরণ সম্পূর্ণ মিলনের জন্য অন্য চরণের অপেক্ষা করে তেমনি দুষ্মন্ত-শকুন্তলার প্রথম মিলন সম্পূর্ণতালাভের জন্য এই দ্বিতীয় মিলনের একান্ত আকাঙক্ষা রাখে। শকুন্তলার এত দুঃখকে নিস্ফল করিয়া শূন্যে দুলাইয়া রাখা যায় না। যজ্ঞের আয়ােজনে যদি কেবল অগ্নিই জ্বলে, কিন্তু তাহাতে অন্নপাক না হয়, তবে নিমন্ত্রিতদের কী দশা ঘটে ? শকুন্তলার শেষ অঙ্ক, নাটকের দেখা গেল, কুমারসম্ভব এবং শকুন্তলায় কাব্যের বিষয় একই। উভয় কাব্যেই কবি দেখাইয়াছেন,