পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রাচীন সাহিত্য । Գ8ֆ কাব্যের উপেক্ষিতা কবি তাহার কল্পনা-উৎসের যত করুণাবারি সমস্তই কেবল জনকতনয়ার পুণ্য অভিষেকে নিঃশেষ করিয়াছেন। কিন্তু আর-একটি যে স্নানমুখী ঐহিকের-সর্বসুখ-বঞ্চিত রাজবধু সীতাদেবীর ছায়াতলে অবগুষ্ঠিত হইয়া দাড়াইয়া আছেন, কবি-কমণ্ডলু হইতে একবিন্দু অভিষেকবারিও কেন তাহার চিরন্দুঃখাভিতপ্ত নম্রললাটে সিঞ্চিত হইল না ! হায় অব্যক্তবেদনা দেবী উৰ্মিলা, তুমি প্রত্যুষের তারার মতো মহাকাব্যের সুমেরুশিখরে একবারমাত্র উদিত হইয়াছিলে, তার পরে অরুণালোকে আর তোমাকে দেখা গেল না । কোথায় তোমার উদয়াচল, কোথায় বা তোমার অস্তশিখরী তাহা প্রশ্ন করিতেও সকলে বিস্মত হইল । কাব্যসংসারে এমন দুটি-একটি রমণী আছে যাহারা কবিকর্তৃক সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হইয়াও অমরলোক হইতে ভ্ৰষ্ট হয় নাই। পক্ষপাতকৃপণ কাব্য তাহাদের জন্য স্থানসংকোচ করিয়াছে বলিয়াই পাঠকের হৃদয় অগ্রসর হইয়া তাহাদিগকে আসন দান করে । কিন্তু এই কবিপরিত্যক্তাদের মধ্যে কাহাকে কে হৃদয়ে আশ্রয় দিবেন, তাহা পাঠকবিশেষের প্রকৃতি এবং অভিরুচির উপর নির্ভর করে। আমি বলিতে পারি, সংস্কৃত-সাহিত্যে কাব্যযজ্ঞশালার প্রান্তভূমিতে যে-কয়টি অনাদৃতার সহিত আমার পরিচয় হইয়াছে তাহার মধ্যে উৰ্মিলাকে আমি প্রধান স্থান দিই। বোধ করি তাহার একটা কারণ, এমন মধুর নাম সংস্কৃত কাব্যে আর দ্বিতীয় নাই! নামকে র্যাহারা নামমাত্ৰ মনে করেন। আমি তাঁহাদের দলে নই। শেকসপীিয়র বলিয়া গেছেন— গোলাপকে যে-কোনো নাম দেওয়া যাক তাহার মাধুর্যের তারতম্য হয় না । গোলাপ সম্বন্ধে হয়তো তাহা খাটিতেও পারে, কারণ গোলাপের মাধুর্য সংকীর্ণ-সীমাবদ্ধ। তাহা কেবল গুটিকতক সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষগম্য গুণের উপর নির্ভর করে । কিন্তু মানুষের মাধুর্য এমন সর্বাংশে সুগোচর নহে, তাহার মধ্যে অনেকগুলি সূক্ষ্ম সুকুমার করি। নাম সেই সৃষ্টিকার্যের সহায়তা করে। একবার মনে করিয়া দেখিলেই হয়, দ্রৌপদীর নাম যদি উৰ্মিলা হইত। তবে সেই পঞ্চবীরপতিগর্বিতা ক্ষত্ৰনারীর দীপ্ত তেজ এই তরুণ কোমল নামটির দ্বারা পদে পদে খণ্ডিত হইত । অতএব এই নামটির জন্য বাল্মীকির নিকট কৃতজ্ঞ আছি । কবিগুরু ইহার প্রতি অনেক অবিচার করিয়াছেন, কিন্তু দৈবক্রমে ইহার নাম যে মাণ্ডবী অথবা শ্রদ্ৰুতকীর্তি রাখেন নাই সে একটা বিশেষ সৌভাগ্য । মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তি সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না, জানিবার কৌতুহলও রাখি না। উৰ্মিলাকে কেবল আমরা দেখিলাম বধূবেশে, বিদেহনগরীর বিবাহসভায় । তার পরে যখন হইতে সে রঘুরাজকুলের সুবিপুল অন্তঃপুরের মধ্যে প্রবেশ করিল। তখন হইতে আর তাহাকে একদিনও দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না । সেই তাহার বিবাহসভার বধূবেশের ছবিটিই মনে রহিয়া গেল। উর্মিলা চিরবধূ— নির্বাককুষ্ঠিতা নিঃশব্দচারিণী। ভবভূতির কাব্যেও তাহার সেই ছবিটুকুই মুহুর্তের জন্য প্রকাশিত হইয়াছিল— সীতা কেবল সমোহকৌতুকে একটিবার মাত্র তাহার উপরে তর্জনী রাখিয়া দেবরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বৎস, ইনি কে ?’ লক্ষ্মণ লজ্জিতহাস্যে মনে মনে কহিলেন, “ওহাে উৰ্মিলার কথা আর্য জিজ্ঞাসা করিতেছেন।” এই বলিয়া তৎক্ষণাৎ লজ্জায় সে ছবি ঢাকিয়া ফেলিলেন ; তাহার পর রামচরিত্রের এত বিচিত্ৰ সুখ-দুঃখ-চিত্ৰশ্রেণীর মধ্যে আর একটিবারও কাহারও, কীেতুহল-অঙ্গুলি এই ছবিটির উপরে পড়িল না। সে তো কেবল বধু উৰ্মিলা-মাত্র। তরুণ শুভ্ৰভালে যেদিন প্রথম সিন্দূরবিন্দুটি পরিয়াছিলেন, উৰ্মিলা চিরদিনই সেইদিনকার নববধূ। কিন্তু রামের অভিষেক-মঙ্গলাচরণের আয়োজনে যেদিন অন্তঃপুরিকাগণ ব্যাপৃত ছিল সেদিন এই বাধুটিও কি সীমান্তের উপর অর্ধবগুণ্ঠন টানিয়া রঘুকুললক্ষ্মীদের সহিত প্ৰসন্নকল্যাণমুখে মঙ্গল্যরচনায় নিরতিশয় ব্যস্ত ছিল না ? আর, যেদিন অযোধ্যা অন্ধকার করিয়া দুই কিশোর রাজভ্ৰাতা সীতাদেবীকে সঙ্গে লইয়া তপস্বীবেশে পথে বাহির হইলেন সেদিন বধু উৰ্মিলা রাজহর্মের কোন নিভৃত শয়নকক্ষে