পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

লোকসাহিত্য ዓ(፩ ዓ হয়— যেখানে যতটুকু অনুকরণের ত্রুটি থাকে তাহাতেই আমাদের কল্পনার ব্যাঘাত করে। তাহাকে অনারূপে দেখিতে পারি না। কিন্তু, শিশু চক্ষে যাহা দেখিতেছে তাহাকে উপলক্ষমাত্র করিয়া আপন মনের মতাে জিনিস মনের মধ্যে গড়িয়া লইতে পারে, মনুষ্যমূর্তির সহিত বস্ত্রখণ্ডরচিত খেলনকের কােনাে বৈসাদৃশ্য তাহার চক্ষে পড়ে না, সে আপনার ইচ্ছারচিত সৃষ্টিকেই সম্মুখে জাজ্বল্যমান করিয়া দেখে | কিন্তু তথাপি ছড়ার এই সকল অযত্নরচিত চিত্রগুলি কেবল যে বালকের সহজ সৃজনশক্তি-দ্বারা সৃজিত হইয়া উঠে তাহা নহে; তাহার অনেক স্থানে রেখার এমন সুস্পষ্টতা আছে যে, তাহারা আমাদের সংশয়ী চক্ষেও অতি সংক্ষেপ বর্ণনায় ত্বরিতচিত্ৰ আনিয়া উপস্থিত করে। এই ছবিগুলি একটি রেখা একটি কথার ছবি। দেশলাই যেমন এক আঁচড়ে দৰ্প করিয়া জ্বলিয়া উঠে বালকের চিত্তে তেমনি একটি কথার টানে একটি সমগ্ৰ চিত্র পলকের মধ্যে জগাইয়া তুলিতে হয়। অংশ যোজনা করিয়া কিছু গড়িয়া তুলিলে চলিবে না। চিৎপুরের মাঠোেত বালি চিক চিক করে। এই একটিমাত্র কথায় একটি বৃহৎ অনুর্বর মাঠ মধ্যাহের রৌদ্রলােকে আমাদের দৃষ্টিপথে আসিয়া উদয় হয় । পরনে তার ডুরে শাড়ি ঘুরে পড়েছে। ডুর শাড়ির ডোরা রেখাগুলি ঘূর্ণজলের আবর্তধারার মতাে তনুগত্র্যষ্টিকে যেমন ঘূরিয়া ঘুরিয়া বেষ্টন করিয়া ধরে তাহা ঐ এক ছাত্র এক মুহূর্তে চিত্রিত হইয়া উঠিয়াছে। আবার পাঠান্তরে আছে— পরনে তার ডুরে কাপড় উড়ে পড়েছে। সে ছবিটিও মন্দ নহে। আয় ঘুম, আয় ঘুম বাগদিপাড়া দিয়ে। বাগদিদের ছেলে ঘুমোয় জাল মুড়ি দিয়ে ৷ ঐ শেষ ছত্রে জাল মুড়ি দিয়া বাগদিদের ছেলেটা যেখানে-সেখানে পড়িয়া কিরূপ অকাতরে ঘুমাইতেছে সে ছবি পাঠকমত্রেই উপলব্ধি করিতে পরিবেন। অধিক কিছু নহে, ঐ জাল মুড়ি দেওয়ার কথা বিশেষ করিয়া বলতেই বাগদি-সন্তানের ঘুম বিশেষরূপে প্রত্যক্ষ হইয়াছে। আয় রে আয় ছেলের পাল মাছ ধরতে যাই । মাছের কঁটা পায়ে ফুটল দোলায় চেপে যাই। দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি, গুনতে গুনতে যাই ৷ এ নদীর জলটুকু টলমল করে। এ নদীর ধারে রে ভাই বালি ঝুরুঝুরু করে। চাদমুখেতে রোদ লেগেছে, রক্ত ফুটে পড়ে ৷ দোলায় করিয়া ছয় পণ কড়ি গুনিতে গুনিতে যাওয়াকে যদি পাঠকেরা ছবির হিসাবে অকিঞ্চিৎকর জ্ঞান করেন, তথাপি শেষ তিন ছত্রকে তাহারা উপেক্ষা করিবেন না। নদীর জলটুকু টলমল করিতেছে এবং তীরের বালি ঝুরুঝুরু করিয়া খসিয়া খসিয়া পড়িতেছে, বালুতটবর্তী নদীর এমন সংক্ষিপ্ত সরল অথচ সুস্পষ্ট ছবি আর কী হইতে পারে! এই তো এক শ্রেণীর ছবি গেল। আর-এক শ্রেণীর ছবি আছে যাহা বৰ্ণনীয় বিষয় অবলম্বন করিয়া একটা সমগ্ৰ ব্যাপার আমাদের মনের মধ্যে জাগ্ৰত করিয়া দেয়। হয়তো একটা তুচ্ছ বিষয়ের উল্লেখে সমস্ত বঙ্গগুহ বঙ্গসমাজ জীবন্ত হইয়া উঠিয়া আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে। সে-সমস্ত তুচ্ছ কথা বড়ো বড়ো সাহিত্যে তেমন সহজে তেমন অবাধে তেমন অসংকোচে প্রবেশ করিতে পারে না। এবং প্রবেশ করিলেও আপনিই তাহার রূপান্তর ও ভাবান্তর হইয়া যায়।