পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

লোকসাহিত্য SS না। শুদ্ধমাত্র মন্ত্রপাঠের দ্বারা একপাল ভেড়া মারা যায় কি না। এ প্রশ্নের উত্তরে ভলটেয়ার বলিয়াছেন, যায়, কিন্তু তাহার সঙ্গে সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে আর্সেনিক বিষও থাকা চাই। মন-ভাৱী-করা যুবতীর পক্ষে আকাশের তারা, নন্দনের পারিজাত এবং প্রাণসমর্পণের প্রস্তাব সন্তোষজনক হইতে পারে ; কিন্তু অধিকাংশ স্থলেই তাহার সঙ্গে সঙ্গে বাজুবন্ধ বা চরণচক্রের প্রয়ােজন হয়। কবি ঐ কথাটা চাপিয়া যান ; তিনি প্রমাণ করিতে চান যে, কেবল মন্ত্রবলে, কেবল ছন্দ এবং ভাবের জোরেই কাজ সিদ্ধ হয়— অলংকারের প্রয়ােজন হইতে পারে, কিন্তু তাহা কাব্যালংকারের। এ দিকে আমাদের পাবনার জনপদবাসিনীরা কাব্যের আড়ম্বর বাহুল্য জ্ঞান করেন এবং তাঁহাদের চিরানুরক্ত গ্রামবাসী কবি মন্ত্রতন্ত্র বাদ দিয়া একেবারেই সোজা টাস্কা-দামের মোটরির কথাটা পাড়িয়া বসেন, সময় নষ্ট করেন না। তবু একটা ছন্দ এবং একটা সুর চাই। এই জগৎপ্রান্তে এই পাবনা জিলার বিলের ধারেও তাহার প্রয়োজন আছে। তাঁহাতে করিয়া ঐ মোটরির দাম এক টাকার চেয়ে অনেকটা বাড়িয়া যায়। ঐ মোেটরিটাকে রসের এবং ভাবের পরশপাথর ছোওয়াইয়া দেওয়া হয়। গানের সেই দুটাে লাইনকে প্রচলিত গদ্যে বিনা সুরে বলিলে তাহার মধ্যে যে-একটি রূঢ় দৈন্য আসিয়া পড়ে, ছন্দে সুরে তাহা নিমেষের মধ্যে ঘুচিয়া যায়, সংসারের প্রতিদিনের ধূলিস্পর্শ হইতে ঐ কাটি তুচ্ছ কথা ভাবের আবরণে আবৃত হইয়া উঠে । r মানুষের পক্ষে ইহার একটা একান্ত প্রয়ােজন আছে। যে-সকল সাংসারিক ব্যাপারের দ্বারা সে সর্বদা ঘনিষ্ঠভাবে পরিবৃত তাহাকে সে ছন্দে লয়ে মণ্ডিত করিয়া তাহার উপর নিত্যসৌন্দর্যময় ভাবের রশ্মিপাত করিয়া দেখিতে চায় । . •ր সেইজন্য জনপদে যেমন চাষবাষ এবং খেয়া চলিতেছে, সেখানে কামারের ঘরে লাঙলের ফলা, ছুতারের ঘরে টেকি এবং স্বর্ণকারের ঘরে টাকা-দামের মেটরি নির্মাণ হইতেছে, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে ভিতরে একটা সাহিত্যের গঠনকার্যও চলিতেছে— তাহার বিশ্রাম নাই। প্রতিদিন যাহা বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন খণ্ড খণ্ড ভাবে সম্পন্ন হইতেছে সাহিতা তাহাকে ঐক্যসূত্রে গাথিয়া নিতাকালের জন্য প্রস্তুত করিতে চেষ্টা করিতেছে। গ্রামের মধ্যে প্রতিদিনের বিচিত্র কাজও চলিতেছে এবং তাহার ছিদ্রে ছিদ্রে চিরদিনের একটা রাগিণী বাজিয়া উঠিবার জন্য নিয়ত প্ৰয়াস পাইতেছে। পদ্মা বাহিয়া চলিতে চলিতে বালুচরের মধ্যে যখন চকচকীর কলরব শুনা যায় তখন তাহাকে কোকিলের কুহুতান বলিয়া কাহারও ভ্রম হয় না, তাহাতে পঞ্চম মধ্যম কড়িকোমল কোনােপ্রকার সুর ঠিকমত লাগে না ইহা নিশ্চয়, কিন্তু তবু ইহাকে পদ্মাচরের গান বলিলে কিছুই অসংগত হয় না। কারণ, ইহাতে সুর বেসুর যাহাই লাগুক, সেই নির্মল নদীর হাওয়ায় শীতের রৌদ্রে, অসংখ্য প্রাণীর জীবনসুখ-সম্ভোগের আনন্দধ্বনি বাজিয়া উঠে । গ্রাম্যসাহিত্যের মধ্যেও কল্পনার তান অধিক থাক বা না থাক, সেই আনন্দের সুর আছে। গ্রামবাসীরা যে জীবন প্রতিদিন ভোগ করিয়া আসিতেছে, যে কবি সেই জীবনকে ছন্দে তালে বাজাইয়া তোলে সে কবি সমস্ত গ্রামের হৃদয়কে ভাষা দান করে। পদ্মাচরের চক্ৰবাক সংগীতের মতো, তাহা নিখুঁত সুরতালের অপেক্ষা রাখে না। মেঘদূতের কবি অলকা পর্যন্ত গিয়াছেন, তিনি উজ্জয়িনীর রাজসভার কবি ; আমাদের অখ্যাত গানের কবি কঠিন দায়ে পড়িয়াও পাবনা শহরের বেশি অগ্রসর হইতে পারে নাই— যদি পারিত, তবে তাহার গ্রামের লোক তাহার সঙ্গ ত্যাগ করিত। কল্পনার সংকীর্ণতা-দ্বারাই সে আপন প্রতিবেশীবর্গকে ঘনিষ্ঠ্যসূত্রে বাধিতে পারিয়াছে, এবং সেই কারণেই তাহার গানের মধ্যে কল্পনাপ্রিয় একক কবির নহে, পরন্তু সমস্ত জনপদের হৃদয় কলরবে ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। সেইজন্য বাংলা জনপদের মধ্যে ছড়া গান কথা আকারে যে সাহিত্য গ্রামবাসীর মনকে সকল সময়েই দােল দিতেছে তাহাকে কাব্যহিসারে গ্রহণ করিতে গেলে তাহার সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে সমস্ত গ্রাম সমস্ত লােকালয়কে জড়াইয়া লইয়া পাঠ করিতে হয় ; তাহারাই ইহার ভাঙা ছন্দ এবং অপূর্ণ মিলকে অর্থে ও ४० ভরাট করিয়া @? গ্রামাসাহিত্য বাংলার গ্রামের ছবির, 5T স্মৃতির