পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Տ\Ն) রবীন্দ্র-রচনাবলী হরগীেরীর গান যেমন সমাজের গান, রাধাকৃষ্ণের গান তেমনি সৌন্দর্যের গান। ইহার মধ্যে যে অধ্যাত্মতত্ত্ব আছে তাহা আমরা ছাড়িয়া দিতেছি । কারণ, তত্ত্ব যখন রূপকের ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চেষ্টা করে তখন তো সে আপন তত্ত্বরূপ গোপন করে। বাহারূপেই সে সাধারণের হৃদয় আকর্ষণ করিয়া থাকে। রাধাকৃষ্ণের রূপকের মধ্যে এমন একটি পদার্থ আছে যাহা বাংলার বৈষ্ণব অবৈষ্ণব তত্ত্বজ্ঞানী ও মূঢ় সকলেরই পক্ষে উপাদেয়, এইজন্যই তাহা ছড়ায় গানে যাত্রায় কথকতায় পরিব্যাপ্ত হইতে পারিয়াছে। সৌন্দৰ্যসূত্রে নরনারীর প্রেমের আকর্ষণ সকল দেশের সাহিত্যেই প্রচারিত। কেবল সামাজিক কর্তব্যবন্ধনে ইহাকে সম্পূর্ণ কুলাইয়া পায় না। সমাজের বাহিরেও ইহার শাসন বিস্তৃত। পঞ্চশরের গতিবিধি সর্বত্রই, এবং বসন্ত অর্থাৎ জগতের যৌবন এবং সৌন্দর্য র্তাহার নিত্য সহচর। নরনারীর প্রেমের এই-যে একটি মোহিনী শক্তি আছে, যে শক্তিবলে সে মুহুর্তের মধ্যে জগতের সমস্ত চন্দ্ৰসূৰ্যতারা পুষ্পকানন নদনদীকে এক সূত্রে টানিয়া মধুরভাবে উজ্জ্বলভাবে আপনার চতুর্দিকে সাজাইয়া আনে, যে প্রেমের শক্তি আকস্মিক অনির্বাচনীয় আবির্ভাবের দ্বারা এতদিনকার বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত উপেক্ষিত বিশ্বজগৎকে চক্ষের পলকে সম্পূর্ণ কৃতকৃতাৰ্থ করিয়া তোলে— সেই শক্তিকে যুগে যুগে দেশে দেশে মনুষ্য অধ্যাত্মশক্তির রূপক বলিয়া অনুভব ও বর্ণনা করিয়াছেন। তাহার প্রমাণ সলোমন হাফেজ এবং বৈষ্ণব কবিদের পদাবলী। দুইটি মনুষ্যের প্রেমের মধ্যে এমন একটি বিরাট বিশ্বব্যাপকতা আছে যে আধ্যাত্মিক ভাবুকদের মনে হয়, সেই প্রেমের সম্পূর্ণ অর্থ সেই দুইটি মনুষ্যের মধ্যেই পর্যাপ্ত নহে ; তাহা ইঙ্গিতে জগৎ ও জগদীশ্বরের মধ্যবর্তী অনন্তকালের সম্বন্ধ ও অপরিসীম ব্যাকুলতা জ্ঞাপন করিতেছে । কাব্যের পক্ষে এমন সামগ্ৰী আর দ্বিতীয় নাই। ইহা একই কালে সুন্দর এবং বিরাট, অন্তরতম এবং বিশ্বগ্রাসী, লৌকিক এবং অনির্বচনীয়। যদিও স্ত্রীপুরুষের প্রকাশ্য মেলামেশা ও স্বাধীন বরণের অভাবে ভারতবর্ষীয় সমাজে এই প্ৰেম লাঞ্ছিত হইয়া গুপ্তভাবে বিরাজ করে, তথাপি ভারতবর্ষের কবিরা নানা সমাজের অবমাননা না করিয়া কাব্যকে সমাজের বাহিরে স্থাপন করিয়াছেন । মালিনীনদীতীরে তপোবনে সহকারসনাথ-বনজ্যোৎস্না-কুঞ্জে নবযৌবনা শকুন্তলা সমাজ-কারাবাসী কবিহীদয়ের কল্পনাস্বপ্ন | দুষ্মন্ত-শকুন্তলার প্রেম সমাজের অতীত, এমন-কি, তাহা সমাজবিরোধী | পুরারবার প্রেমোন্মত্ততা সমাজবন্ধন ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া নদীগিরিবনের মধ্যে মদমত্ত বন্য হস্তীর মতো উদামভাবে পরিভ্রমণ করিয়াছে। মেঘদূত বিরহের কাব্য। বিরহাবস্থায় দৃঢ়বদ্ধ দাম্পত্যসূত্রে কিঞ্চিৎ ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়া মানব যেন পুনশ্চ স্বতন্ত্রভাবে ভালোবাসিবার অবসর লাভ করে। স্ত্রীপুরুষের মধ্যে সেই ব্যবধান যেখানে পড়ে হৃদয়ের প্রবল অভিমুখী গতি আপনাকে স্বাধীনভাবে প্রবাহিত করিতে স্থান পায় । কুমারসম্ভবে কুমারী গীেরী যদি প্রচলিত সমাজনিয়মের বিরুদ্ধে শৈলীতপোবনে একাকিনী মহাদেবের সেবা না করিতেন, তবে তৃতীয় সর্গের ন্যায়। অমন অতুলনীয় কাব্যের সৃষ্টি হইত। কী করিয়া ? এক দিকে বসন্তাপুষ্পাভরণা শিরীষপেলবা বেপথুমতী উমা, অন্য দিকে যোগাসীন মহাদেবের অগাধস্তম্ভিত সমুদ্রবিশাল হৃদয়, লোকালয়ের নিয়মপ্রাচীরের মধ্যে বিশ্ববিজয়ী প্রেমের এমন মহান সুযোগ মিলিত কোথায় ? যাহা হউক, মানবরচিত সমােজ আপনার মধ্যে আপনি সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত নয়। যে শক্তি সমাজকে কল্পনার দ্বারা উপভোগ না করিয়া মানুষ থাকিতে পারে না। পার্থিব সমাজে যদি বা বাধা পায় তবে দ্বিগুণ তীব্রতার সহিত আধ্যাত্মিক ভাবের মধ্যে তাহাকে আয়ত্ত করিতে চেষ্টা করে । বৈষ্ণবের গান যে দেখিতে দেখিতে সমস্ত ভারতবর্ষ ছাইয়া ফেলিয়াছে ইহাই তাহার প্রধান কারণ। বৈষ্ণবের গান স্বাধীনতার গান | তাহা জাতি মানে না, কুল মানে না । অথচ এই উচ্ছঙ্খলতা সৌন্দর্যবন্ধনে হৃদয়বন্ধনে নিয়মিত । তাহা অন্ধ ইন্দ্ৰিয়ের উদভ্ৰান্ত উন্মত্ততমাত্র নহে।