পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় br> a অমঙ্গলজনক। আমাদের ভ্রম লইয়া আমরা কাদি বৈ তো নয়। যাহা যায় তাহাকে আমরা থাকে মনে করি— যে নিজের ও সমস্ত জগতের জন্য হইয়াছে তাহাকে আমরা আমারই জন্য হইয়াছে মনে করি— যাহাকে আমরা কখনোই চিরদিন ভালোবাসিতে পারিব না। তাহাকে আমরা চিরদিনের জন্য চাই- কিন্তু প্রকৃতি-মাতা আমাদের এ-সকল মিছে আবদার শুনিবেন কেন, "আমাদের হাত হইতে মাটির ঢেলা কড়িয়া লন, আমরা কাদিয়া-কাটিয়া সারা হই; কিন্তু সে কান্না ফুরায়, সে অশ্রুজল শুকায়, প্রকৃতির উপর হইতে আমাদের অভিমান চলিয়া যায় ; আবার আমরা হাসি-খেলি, সংসারের কাজ করি, মাতার প্রতি আবার বিশ্বাস জন্মায় । কিন্তু যে শিশু গো ধরিয়াই থাকে, কিছুতেই প্ৰসন্ন হইতে চায় না, তাহার পক্ষে শুভ নহে ; সে মায়ের কােছ হইতে মার খায় ; সেই রুদ্ধ গৃহ । ‘আমি বৈরাগ্য শিখাইতেছি । অনুরাগ বদ্ধ করিয়া না রাখিলে তাহাকেই বৈরাগ্য বলে ; অর্থাৎ বৃহৎ অনুরাগকেই বৈরাগ্য বলে । প্রকৃতির বৈরাগ্য দেখো । সে সকলকেই ভালোবাসে বলিয়া কাহারও জন্য শোক করে না। তাহার দুই-চারিটা চন্দ্ৰসূর্য গুড়া হইয়া গেলেও তাহার মুখ অন্ধকার হয় না, এক দিনের জন্যও তাহার ঘরকন্নার কাজ বন্ধ হয় না, অথচ একটি সামান্য । তৃণের অগ্রভাগেও তাহার অসীম হৃদয়ের সমস্ত যত্ন, সমস্ত আদর স্থিতি করিতেছে- তাহার অনন্ত শক্তি কাজ করিতেছে। তাহার কোলে আসিতেছে ও যাইতেছে ; তাহার মুখ চিরপ্রসন্ন, তাহার স্নেহ চিরবিকশিত । “যখন আমরা নিতান্ত এক জনের মধ্যেই আচ্ছন্ন হইয়া থাকি তখন আমরা জানিতেই পারি না আমাদের কতখানি ভালোবাসিবার ক্ষমতা । একটি ক্ষুদ্র বস্তুও যখন চোখের নিতান্ত কাছে ধরি তখন মনে হয় সেই ক্ষুদ্র বস্তুটি ছাড়া আমাদের আর কিছুই দেখিবার ক্ষমতা নাই। সেই ব্যবধান । অপসারিত করিয়া দাও, বৃহৎ জগৎ তাহার সৌন্দর্যরাশি লইয়া তোমার সম্মুখে আসিয়া * দাড়াইবে । “এইজন্য সচরাচর ভালোবাসাকে লোকে অন্ধ বলে ; অথচ ভালোবাসার একটি প্রধান গুণ এই যে, সে দৃষ্টিশক্তি প্রখর করিয়া দেয়— ভালোবাসা চােখের উপর হইতে ব্যবধান দূর করিয়া দেয় । অপ্রেমিক কিছু দেখেই না, যদি বা দেখে ভিতর পর্যন্ত দেখিতে পায় না। কিন্তু ক্ষুদ্র প্রেম অনেকটা অন্ধ বটে, কারণ, সে একটুকুকেই এত করিয়া দেখে যে আর-কিছুই দেখিতে পায় না । সে বৃহৎ সমগ্রের সহিত সেই একটুর সম্বন্ধ নির্ণয় করিতে পারে না ; সে সেই একটুকুকে অংশ বলিয়া না জানিয়া সর্বেসর্ব মনে করে । এই ভ্ৰমে পড়িয়া অবশেষে তাহাকে শোক করিতেই হয় । এইজন্যই অনেকের দিকে চাহিয়া এই ভ্ৰম দূর করা আবশ্যক। আপনাকে রুদ্ধ করিয়া রাখিলে এই ভ্ৰম ক্রমাগতই ঘনীভূত হইতে থাকে। “সকল মানবহৃদয়েই প্রেমের অমৃত-উৎস আছে ; তোহার জন্যই জগতে সন্ধান পড়িয়া গেছে। প্রতিদিন ভাই ভগ্নী বন্ধু, চন্দ্র তারা পুষ্প, সেই উৎস-আবিষ্কারের জন্য হৃদয়ে আঘাত করিতেছে— খনন করিতেছে। কত কঠিন পাষাণের স্তর বিদীর্ণ”করিতে হইতেছে ; প্রতিদিন পাষাণ টুটিতেছে, ধৈর্য টুটিতেছে না। অল্প অল্প স্রোত উঠিতেছে, আবার শুকাইয়া যাইতেছে। কিন্তু এক দণ্ড আঘাতের বিশ্রাম নাই। যত দিন যাইতেছে ততই মানবহৃদয়ের সেই অমৃত-উৎস গভীরতর হইতেছে । - “যদি এমনি হয় যে, এক জন সহসা এক আঘাতে তোমার হৃদয়ের কঠিন স্তর বিদীর্ণ করিয়া অমৃত-উৎসের অনন্ত মূল অবারিত করিয়া দিয়াছে তবে সেই উৎস কি কেবল খননকারীর নাম-ক্ষোদিত সমাধিপাষাণ দিয়া ঢাকিয়া রাখিবে ? সংসারে শতসহস্ৰ তৃষিত আছে।