পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G 8૨ রবীন্দ্র-রচনাবলী * তিনি ছিলেন রোমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসী, অপর পক্ষে বৈদাস্তিক,—তেজস্বী, নিভীক, ত্যাগী, বহুশ্রুত ও অসামান্তপ্রভাবশালী । অধ্যাত্মবিষ্ঠায় তার অসাধারণ নিষ্ঠা ও ধীশক্তি আমাকে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় আকৃষ্ট করে । শান্তিনিকেতন আশ্রমে বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠায় তাকেই আমার প্রথম সহযোগী পাই । এই উপলক্ষ্যে কতদিন আশ্রমের সংলগ্ন গ্রামপথে পদচারণ করতে করতে তিনি আমার সঙ্কে আলোচনাকালে ষে-সকল দুরূহ তত্বের গ্রন্থিমোচন করতেন আজও তা মনে করে বিস্মিত হই । 疊 এমন সময়ে লর্ড কর্জন বঙ্গব্যবচ্ছেদ-ব্যাপারে দৃঢসংকল্প হলেন। এই উপলক্ষ্যে রাষ্ট্ৰক্ষেত্রে প্রথম হিন্দুমুসলমান-বিচ্ছেদের রক্তবর্ণ রেখাপাত হল। এই বিচ্ছেদ ক্রমশ আমাদের ভাষা সাহিত্য আমাদের সংস্কৃতিকে খণ্ডিত করবে, সমস্ত বাঙালিজাতকে কৃশ করে দেবে এই আশঙ্কা দেশকে প্রবল উদ্বেগে আলোড়িত করে দিল । বৈধ আন্দোলনের পন্থায় ফল দেখা গেল না। লর্ড মরলি বললেন, যা স্থির হয়ে গেছে তাকে অস্থির করা চলবে না । সেই সময়ে দেশব্যাপী চিত্তমথনে যে আবর্ত আলোড়িত হয়ে উঠল তারই মধ্যে একদিন দেখলুম এই সন্ন্যাসী বীপ দিয়ে পড়লেন। স্বয়ং বের করলেন “সন্ধ্যা” কাগজ, তীব্র ভাষায় যে মদির রস ঢালতে লাগলেন তাতে সমস্ত দেশের রক্তে অগ্নিজালা বইয়ে দিলে। এই কাগজেই প্রথমে দেখা গেল বাংলাদেশে আভাসে ইঙ্গিতে বিভীষিকাপস্থার স্বচনা । বৈদাস্তিক সন্ন্যাসীর এতবড়ো প্রচণ্ড পরিবর্তন আমার কল্পনার অতীত ছিল । এই সময়ে দীর্ঘকাল তার সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাং হয় নি। মনে করেছিলুম হয়তো আমার সঙ্গে তার রাষ্ট্র-আন্দোলনপ্রণালীর প্রভেদ অনুভব করে আমার প্রতি তিনি বিমুখ হয়েছিলেন অবজ্ঞাবশতই । নানাদিকে নানা উৎপাতের উপসর্গ দেখা দিতে লাগল। সেই অন্ধ উন্মত্ততার দিনে একদিন যখন জোড়াসাকোয় তেতালার ঘরে একলা বসে ছিলেম হঠাৎ এলেন উপাধ্যায়। কথাবার্তার মধ্যে আমাদের সেই পূর্বকালের আলোচনার প্রসঙ্গও কিছু উঠেছিল। আলাপের শেষে তিনি বিদায় নিয়ে উঠলেন। চৌকাঠ পর্যন্ত গিয়ে একবার মুখ ফিরিয়ে দাড়ালেন। বললেন, “রবিবাৰু, আমার খুব পতন হয়েছে।” এই বলেই আর অপেক্ষা করলেন না, গেলেন চলে। স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, এই মর্মান্তিক কথাটি বলবার জন্তেই তার আসা। তখন কর্মজাল জড়িয়ে ধরেছে, নিষ্কৃতির উপায় ছিল না।