পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তিন সঙ্গী ՏՕԳ মেয়েকে । লোকসমাজে নাতনির লজ্জা বঁাচাবার জন্যে মর্মাহত অধ্যাপক কোথায় অন্তর্ধন করেছেন জানি নে। অনতিকালের মধ্যে ভবাতোয্যের অপ্রত্যাশিত পদোন্নতির সংবাদ এল । মস্ত একটা বিদায়ভোজের আয়োজন হল। শুনেছি। খরচটা দিয়েছে। ভবতোষ গোপনে নিজের পকেট থেকে । আমরাও নিজের পকেট থেকেই খরচ দিয়ে গুণ্ডা লাগিয়ে ভোজটা দিলুম। লণ্ডভণ্ড করে । কাগজে কংগ্রেসওয়ালদের প্রতিই সন্দেহ প্ৰকাশ করেছিল ভবাতোষেরই ইশারায় । আমি জানি এই সৎকার্যে তারা লিপ্ত ছিল না। যে নাগরা জুতো লেগেছিল পলায়মানের পিঠে, সেটা অধ্যাপকেরই এক প্রাক্তন ছাত্রের প্রশস্ত পায়ের মাপে । পুলিস এল গোলমালের অনেক পরে-ইনস্পেক্টর আমার বন্ধু, লোকটা সহৃদয় ।” চিঠিখানা পড়লুম, প্রাক্তন ছাত্রটির প্রতি ঈর্ষা হল। অচিরার সঙ্গে প্রথম কথাটি শুরু করাই সব চেয়ে কঠিন কাজ। আমি বাঙালি মেয়েকে ভয় করি । বোধ করি চেনা নেই বলেই । অথচ কাজে যোগ দেবার কিছু আগেই কলকাতায় কাটিয়ে এসেছি । সিনেমািমঞ্চপথবর্তনী বাঙালি মেয়ের নতুন চাষ করা ভূবিলাস দেখে তো স্তম্ভিত হয়েছি- তারা সব জাতবান্ধবী- থাক তাদের কথা। কিন্তু অচিরাকে দেখলুম একালের ঠেলাঠেলি ভিড়ের বাইরে— নির্মল আত্মমর্যাদায়, স্পর্শভীরু মেয়ে । আমি তাই ভাবছি প্ৰথম কথাটি শুরু করব কী করে । জনরব এই যে কাছাকাছি ডাকাতি হয়ে গেছে। ভাবলুম, হিতৈষী হয়ে বলি ‘রাজা-বাহাদুরকে বলে আপনার জন্যে পাহারার বন্দোবস্ত করে দিই। ইংরেজ মেয়ে হলে হয়তো গায়েপড়া আনুকূল্য সইতে পারত না, মাথা বঁকিয়ে বলত, “সে ভাবনা আমার ” এই বাঙালি মেয়ে অচেনার কাছ থেকে কী ভাবে কথাটা নেবে। আমার জানা নেই, হয়তো আমাকেই ডাকাত বলে সন্দেহ করবে । ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটল সেটা উল্লেখযোগ্য । দিনের আলো প্ৰায় শেষ হয়ে এসেছে। অচিরার সময় হয়েছে। ঘরে ফেরবার। এমন সময় একটা হিন্দুস্থানী গোয়ার এসে তার হাত থেকে তার খাতা আর থলিটা নিয়ে যখন ছুটেছে আমি তখনই বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললুম, “কোনো ভয় নেই। আপনার ” এই বলে ছুটে সেই লোকটার ঘাড়ের উপর পড়তেই সে ব্যাগ খাতা ফেলে দৌড় মারলে। আমি লুঠের মাল নিয়ে এসে অচিরাকে দিলুম। অচিরা বললে, “ভাগ্যিস আপনি-” আমি বললেম, “আমার কথা বলবেন না, ভাগ্যিস ঐ লোকটা এসেছিল ।” “তার মানে ৷” “তার মানে তারই কৃপায় আপনার সঙ্গে আর্মির প্রথম আলাপ হয়ে গেল।” অচিরা বিস্মিত হয়ে বললে, “কিন্তু ও যে ডাকাত !” “এমন অন্যায় অপবাদ দেবেন না । ও আমার বীরকন্দাজ, রামশরণ ।” অচিরা মুখের উপর খয়েরি রঙের আঁচল টেনে নিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসি থামতে চায় না। কী মিষ্টি তার ধ্বনি। যেন ঝরনার নীচে নুড়িগুলো ঠুনঠুন করে উঠল সুরে সুরে। হাসি-অবসানে সে বললে, “কিন্তু সত্যি হলে খুব মজা হত।” "মজা কার পক্ষে ?” “যাকে নিয়ে ডাকাতি ।” "আর উদ্ধারকর্তার ?” বাড়ি নিয়ে গিয়ে তাকে এক পেয়ালা চা খাইয়ে দিতুম আর গোটা দুয়েক স্বদেশী বিস্কুট ।” "আর এই ফাকি উদ্ধারকর্তার কী হবে ।” "যেরকম শোনা গেল তার তো আর কিছুতে দরকার নেই, কেবল প্ৰথম কথাটা ।” "ঐ প্রথম পদক্ষেপেই গণিতের অগ্ৰগতিটা কি বন্ধ হবে।” "কেন হবে । ওকে চালাবার জন্যে বীরকন্দাজের সাহায্য দরকার হবে না।” বসন্ম সেখানেই ঘাসের উপরে। একটা কটা, গাছের উড়ির উপরে বসে ছিল আঁচিরা । (