পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOOR রবীন্দ্র-রচনাবলী ܔ 5围 ছেলেটির যেমনি কথা ফুটল অমনি সে বললে, “গল্প বলে ।” দিদিমা বলতে শুরু করলেন, “এক রাজপুণ্ডুর, কোটালের পুকুর, সদাগরের পুত্ত্বর-” গুরুমশায় হেঁকে বললেন, “তিন-চারে বারো ।” কিন্তু তখন তার চেয়ে বড়ো ইহাক দিয়েছে রাক্ষসটা “ইউ মাউ খাউ”- নামতার হুংকার ছেলেটার কানে পৌঁছয় না। যারা হিতৈষী তারা ছেলেকে ঘরে বন্ধ করে গভীর স্বরে বললে, “তিন-চারে বারো এটা হল সত্য ; আর রাজপুকুর, কোটালের পুকুর, সওদাগরের পুণ্ডুর, ওটা হল মিথ্যে, অতএব,--” ছেলেটির মন তখন সেই মানসচিত্রের সমুদ্র পেরিয়ে গেছে মানচিত্রে যার ঠিকানা মেলে না ; তিন-চারে বারো তার পিছে পিছে পাড়ি দিতে যায়, কিন্তু সেখানে ধারাপাতের হলে পানি পায় না। হিতৈষী মনে করে, নিছক দুষ্টমি, বেতের চোটে শোধন করা চাই। দিদিমা গুরুমশায়ের গতিক দেখে চুপ। কিন্তু আপদ বিদায় হতে চায় না, এক যায় তো আর আসে। কথক এসে আসন জুড়ে বসলেন। তিনি শুরু করে দিলেন এক রাজপুত্রের বনবাসের কথা। যখন রাক্ষসীর নাক কাটা চলছে তখন হিতৈষী বললেন, “ইতিহাসে এর কোনো প্ৰমাণ নেই ; যার প্রমাণ পথে ঘাটে সে হচ্ছে, তিন-চারে বারো ।” ততক্ষণে হনুমান লাফ দিয়েছে আকাশে, অতি উৰ্ব্বে ইতিহাস তার সঙ্গে কিছুতেই পাল্লা দিতে পারে না। পাঠশালা থেকে ইস্কুলে, ইস্কুল থেকে কলেজে ছেলের মনকে পুটপাকে শোধন করা চলতে লাগল। কিন্তু যতই, চোলাই করা যাক, ঐ কথাটুকু কিছুতেই মরতে চায় না। “গল্প বলে”। NR এর থেকে দেখা যায়, শুধু শিশুবয়সে নয়, সকল বয়সেই মানুষ গল্পপোষ্য জীব। তাই পৃথিবী জুড়ে মানুষের ঘরে ঘরে, যুগে যুগে, মুখে মুখে, লেখায় লেখায়, গল্প যা জমে উঠেছে তা মানুষের সকল সঞ্চয়কেই ছাড়িয়ে গেছে। হিতৈষী একটা কথা ভালো করে ভেবে দেখে না, গল্পরচনার নেশাই হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সবশেষের নেশা ; তঁকে শোধন করতে না পারলে মানুষকে শোধন করার আশা করা যায় না। একদিন তিনি তঁর কারখানাঘরে আগুন থেকে জল, জল থেকে মাটি গড়তে লেগে গিয়েছিলেন । সৃষ্টি তখন গলদঘর্ম, বাষ্পভারাকুল। ধাতুপাথরের পিণ্ডগুলো তখন থাকে থাকে গাথা হচ্ছে ; চার দিকে মাল মসলা ছড়ানো আর দমদম পিটনি । সেদিন বিধাতাকে দেখলে কোনোমতে মনে করা যেতে পারত না যে, তার মধ্যে কোথাও কিছু ছেলেমানুবি আছে। তখনকার কাণ্ডকারখানা যাকে বলে “সারিবীন’ । তার পরে কখন শুরু হল প্ৰাণের পত্তন। জাগল ঘাস, উঠল গাছ, ছুটিল পশু, উড়ল পাখি। কেউ বা মাটিতে বাধা থেকে আকাশে অঞ্জলি পেতে দাঁড়াল, কেউ বা ছাড়া পেয়ে পৃথিবীময় আপনাকে বহুধা বিস্তার করে চলল, কেউ বা জলের যবনিকাতলে নিঃশব্দ নৃত্যে পৃথিবী প্ৰদক্ষিণ করতে বান্ত, কেউ বা আকাশে ডানা মেলে সূর্যালোকের বেদীতলে গানের অর্ঘ্যরচনায় উৎসুক। এখন থেকেই ধরা পড়তে লাগল বিধাতার মনের চাঞ্চল্য । এমন করে বহু যুগ কেটে যায়। হঠাৎ এক সময়ে কোন খেয়ালে সৃষ্টিকর্তার কারখানায় উনপঞ্চাশ পবনের তলাব পড়ল। তাদের সব কটাকে নিয়ে তিনি মানুষ গড়লেন। এতদিন পরে আরম্ভ হল ঠার