পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

OO রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি বললেম, “যেমন তীরের মধ্যে বাধা পড়ে হয় নদী, তেমনি ঘেরের মধ্যে ধরা পডেই তো সৃষ্টি। একই জিনিস ঘেরের মধ্যে আটকা পড়ে কোথাও হীরের টুকরো, কোথাও বটের গাছ।” গাছ বললে, “তোমার ঘেরটা কী রকম শুনি ।” আমি বললেম, “সেইটি আমার মন । তার মধ্যে যা ধরা পড়ছে তাই নানা সৃষ্টি হয়ে উঠছে।” গাছ বললে, “তোমার সেই বেড়াঘেরা সৃষ্টিটা আমাদের চন্দ্ৰসূর্যের পাশে কতটুকুই বা দেখায়।” আমি বললেম, “চন্দ্ৰসূর্যকে দিয়ে তাকে তো মাপা যায় না, চন্দ্ৰসূর্য যে বাইরের জিনিস।” “তা হলে মাপবে কী দিয়ে ।” “সুখ দিয়ে, বিশেষত দুঃখ দিয়ে।” গাছ বললে, “এই পূবে হাওয়া আমার কানে কানে কথা কয়, আমার প্রাণে প্ৰাণে তার সাড়া জাগে । কিন্তু, তুমি যে কিসের কথা বললে আমি কিছুই বুঝলেম না।” আমি বললেম, “বোঝাই কী করে । তোমার ঐ পূবে হাওয়াকে আমাদের বেড়ার মধ্যে ধরে বীণার তারে যেমনি বেঁধে ফেলেছি, অমনি সেই হাওয়া এক সৃষ্টি থেকে একেবারে আর-এক সৃষ্টিতে এসে. পৌছয়। এই সৃষ্টি কোন আকাশে যে স্থান পুায়, কোন বিরাট চিত্তের স্মরণাকাশে, তা আমিও ঠিক জানি নে । মনে হয়, যেন বেদনার একটা আকাশ আছে । সে আকাশ মাপের আকাশ নয় ?” “আর, ওর কােল ?” “ওর কােলও ঘটনার কাল নয়, বেদনার কাল । তাই সে কাল সংখ্যার অতীত ।” "দুই আকাশ দুই কালের জীব তুমি, তুমি অদ্ভুত। তোমার ভিতরের কথা কিছুই বুঝলেম না।” “নাই বা বুঝলে ।” “আমার বাইরের কথা তুমিই কি ঠিক বোঝ।” “তোমার বাইরের কথা আমার ভিতরে এসে যে কথা হয়ে ওঠে তাকে যদি বোঝা বল তো সে বোঝা, যদি গান বল তো গান, কল্পনা বল তো কল্পনা ।” V) গাছ তার সমস্ত ডালগুলো তুলে আমাকে বললে, “একটু থামে। তুমি বড়ো বেশি ভাবাে, আর বড়ো বেশি বকো ।” শুনে আমার মনে হল, এ কথা সত্যি । আমি বললেম, “চুপ করবার জন্যেই তোমার কাছে আসি, কিন্তু অভাসদোষে চুপ করে করেও বাকি ; কেউ কেউ যেমন ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও চলে।” কাগজটা পেন্সিলটা টেনে ফেলে দিলেম, রইলেম ওর দিকে অনিমেষ তাকিয়ে । ওর চিকন পাতাগুলো ওস্তাদের আঙুলের মতো আলোকবীণায় দ্রুত তালে ঘা দিতে লাগল। হঠাৎ আমার মন বলে উঠল, “এই তুমি যা দেখছি আর এই আমি যা ভাবছি, এর মাঝখানের যোগটা কোথায় ।” আমি তাকে ধমক দিয়ে বললেম, “আবার তোমার প্রশ্ন ? চুপ করে ।” চুপ করে রইলেম, একদুষ্টে চেয়ে দেখলেম । বেলা কেটে গেল । গাছ বললে, “কেমন, সব বুঝেছি ?” আমি বললেম, “বুঝেছি।” সেদিন তো চুপ করেই কাটল । পরদিনে আমার মন আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, “কাল গাছটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলে ‘বুঝেছি, কী বুঝেছি বলে তো ।” আমি বললেম, “নিজের মধ্যে মানুষের প্রাণটা নানা ভাবনায় ঘোলা হয়ে গেছে । তাই, প্ৰাণের