পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

OS রবীন্দ্র-রচনাবলী অরণ্যে অরণ্যে তারই পাঠশালা খুলেছি। তাই যারা ক্লান্ত তারা তোমার ছায়ায় আসে, যারা আর্ত তারা তোমার বাণী খোজে ।” আমার স্তব শুনে বটের ভিতরকার প্রাণপুরুষ বুঝি খুশি হল ; সে বলে উঠল, “আমি বেরিয়েছি। মরুদৈত্যের সঙ্গে লড়াই করতে ; কিন্তু আমার এক ছোটাে ভাই আছে, সে যে কোন লড়াইয়ে কোথায় চলে গেল। আমি তার আর নাগাল পাই নে। কিছুক্ষণ আগে তারই কথা কি তুমি বলছিলো।” “হঁ্যা, তাকেই আমরা নাম দিয়েছি- মন ।” “সে আমার চেয়ে চঞ্চল। কিছুতে তার সন্তোষ নেই। সেই অশান্তটার খবর আমাকে দিতে পার ?” আমি বললেম, “কিছু কিছু পরিবৈকি। তুমি লড়ছ বঁচবার জন্যে, সে লড়ছে পাবার জন্যে, আরো দূরে আর-একটা লড়াই চলছে ছাড়বার জন্যে । তোমার লড়াই অসাড়ের সঙ্গে, তার লড়াই অভাবের সঙ্গে, আরো একটা লড়াই আছে সঞ্চায়ের সঙ্গে। লড়াই জটিল হয়ে উঠল, ব্যুহের মধ্যে যে প্রবেশ করছে বৃহ থেকে বেরোবার পথ সে খুঁজে পাচ্ছে না। হার জিত অনিশ্চিত বলে ধাদা লাগল। এই দ্বিধার মধ্যে তোমার ঐ সবুজ পতাকা যোদ্ধাদের আশ্বাস দিচ্ছে। বলছে, ‘জয়, প্ৰাণের জয় ।" গানের তান বেড়ে বেড়ে চলেছে, কোন সপ্তক থেকে কোন সপ্তকে চড়ল তার ঠিকানা নেই। এই স্বরসংকটের মধ্যে তোমার তাম্বুরাটি সরল তারে বলছে, "ভয় নেই, ভয় নেই।’ বলছে, “এই তো মূল সুর আমি বেঁধে রেখেছি, এই আদি প্রাণের সুর। সকল উন্মত্ত তানই এই সুরে সুন্দরের ধুয়োয় এসে মিলবে আনন্দের গানে। সকল পাওয়া, সকল দেওয়া ফুলের মতো ফুটবে, ফলের মতো ফলবে।” न »७९७ আগমনী আয়োজন চলেইছে। তার মাঝে একটুও ফাক পাওয়া যায় না যে ভেবে দেখি, কিসের আয়োজন । তবুও কাজের ভিড়ের মধ্যে মনকে এক-একবার ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞাসা করি, “কেউ আসবে বুঝি ?” মন বলে, “রোসো। আমাকে জায়গা দখল করতে হবে, জিনিসপত্র জোগাতে হবে, ঘরবাড়ি গড়তে হবে, এখন আমাকে বাজে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কোরো না ।” চুপচাপ করে আবার খাটতে বসি ।। ভাবি, জায়গা-দখল সারা হবে, জিনিসপত্র সংগ্ৰহ শেষ হবে, ঘরবাড়ি-গড়া বাকি থাকবে না, তখন শেষ জবাব মিলবে। জায়গা বেড়ে চলেছে, জিনিসপত্র কম হল না, ইমারতের সাতটা মহল সারা হল। আমি বললেম, “এইবার আমার কথার একটা জবাব দাও ।” মন বলে, “আরো রোসো, আমার সময় নেই।” আমি বললেম, “কেন, আরো জায়গা চাই ? আরো ঘর ? আরো সরঞ্জাম ?” মন বললে, “চাই বৈকি ?” আমি বললেম, “এখনো যথেষ্ট হয় নি ?” মন বললে, “এতটুকুতে ধরবে কেন।” আমি জিজ্ঞাসা করলেম, “কী ধরবে। কাকে ধরবে ।” মন বললে, “সে-সব কথা পরে হবে ।” তবু আমি প্রশ্ন করলেম, “সে বুঝি মন্ত বড়ো ?” মন উত্তর করলে, “বড়ো বৈকি ?” এত বড়ো ঘরেও তাকে কুলোবে না, এত মন্ত জায়গায় ! আবার উঠে-পড়ে লাগলেম । দিনে আহার নেই, রাত্রে নিদ্রা নেই। যে দেখলে সেই বাহবা দিলে ; বললে, “কাজের লোক বটে । ” এক একবার কেমন আমার সন্দেহ হতে লাগল, বুঝি মন বােদরটা আসল কথার জবাব জানে না।