পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q বিধতা লক্ষলক্ষ কোটিকোটি মানুষ সৃষ্টি করে চলেছেন, তবু মানুষের আশা মেনে না ; বলে, আমরা নিজে মানুষ তৈরি করব। তাই দেবতার সজীব পুতুল-খেলার পাশাপাশি নিজের খেলা শুরু হল পুতুল নিয়ে, সেগুলো মানুষের আপনি-গড়া মানুষ । তার পরে ছেলেরা বলে ‘গল্প বলে ; তার মানে, ভাষায়-গড়া মানুষ বানাও। গড়ে উঠল কত রাজপুত্ত্বর, মীর পুকুর, সুয়োরানী, দুয়োরানী, মৎস্যনারীর উপাখ্যান, আরব্য উপন্যাস, রবিনসন ক্রুসো। পৃথিবীর জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলল। বুড়েরাও আপিসের ছুটির দিনে বলে, মানুষ বানাও ; হল আঠারো-পর্ব মহাভারত প্ৰস্তুত । আর, লেগে গিয়েছেন গল্প-বানিয়ের দল দেশে দেশে । 曼 নাতনির ফরমাশে কিছুদিন থেকে লেগেছি মানুষ গড়ার কাজে ; নিছক খেলার মানুষ, সত্যমিথ্যের কোনো জবাবদিহি নেই। গল্প যে শুনছে তার বয়স ন বছর, আর যে শোনাচ্ছে সে সত্তর পেরিয়ে গৈছে । কাজটা একলাই শুরু করেছিলুম, কিন্তু মালমসলা এতই হালকা ওজনের যে, নির্বিচারে পুপুও দিল যোগ । আর-একটা লোককে রেখেছিলুম, তার কথা হবে পরে। অনেক গল্প শুরু হয়েছে এই বলে যে, এক যে ছিল রাজা । আমি আরম্ভ করে দিলুম, এক যে আছে মানুষ । তার পরে লোকে যাকে বলে গাপপো, এতে তারও কোনো আঁচ নেই। সে মানুষ ঘোড়ায় চড়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে গেল না । একদিন রাত্রি দশটার পর এল আমার ঘরে । আমি বই পড়ছিলুম। সে বললে, দাদা, খিদে পেয়েছে। রাজপুত্ত্বরের গল্প অনেক শুনেছি ; কখনোই তার খিদে পায় না। কিন্তু এর খিদে পেয়ে গেল গৌড়াতেই, শুনে খুশি হলুম। খিদে-পাওয়া লোকের সঙ্গে ভাব করা সহজ। খুশি করবার জন্যে গলির মোড়ের থেকে বেশি দূর যেতে হয় না। দেখলুম, লোকটার দিব্যি খাবার শখ। ফরমাশ করে মুড়োর ঘণ্ট, লাউচিংড়ি, কঁাটােচচ্চড়ি ; বড়োবাজারের মালাই পেলে বাটিটা চেচেপ্‌ছে খায়। এক-একদিন শখ যায় আইসক্রিমের। এমন করে খায় সে দেখবার যোগ্য। মজুমদারের জামাইবাবুর সঙ্গে অনেকটা মেলে। একদিন ঝমােঝম বৃষ্টি। বসে বসে ছবি আঁকছি। এখানকার মাঠের ছবি। উত্তর দিকে বরাবর চলে গৈছে। রাঙামাটির রাস্তা-দক্ষিণ দিকে পোড়ো জমি, উচুনিচু ঢেউ খেলানো, মাঝে মাঝে ঝাঁকড়া বুনো খেজুর ) দূরে দুটাে চারটি তালগাছ আকাশের দিকে কঙালের মতো তাকিয়ে। তারই পিছনে জমে উঠেছে ঘন মেঘ, যেন একটা প্ৰকাণ্ড নীল বাঘ ওৎ পেতে আছে, কখন এক লাফে মােঝ-আকাশে উঠে সূৰ্যটাকে দেবে থাবার ঘা। বাটিতে রঙ গুলো তুলি বাগিয়ে এই সব এঁকে চলেছি। দরজায় পড়ল ঠেলা। খুলে দেখি ডাকাত নয়, দৈত্য নয়, কোটালের পুকুর নয়- সেই লোকটা । স্বাঙ্গ বেয়ে জল ঝরছে, ময়লা ভিজে জামা গায়ে লেপট গেছে, কেঁচার ডগায় কাদা, জুতোয় কাদার পণ্ডি । আমি বললুম, এ কী ! সে বললে, যখন বেরিয়েছিলুম খটুখািট রোদন্দুর । আদ্ধেক পথে আসতে বৃষ্টি নামল। তোমার ঐ বিছানার চাদরটা যদি দাও তো কাপড় ছেড়ে গায়ে জড়িয়ে বসি । হুকুম পাবার সবুর সাইল না। চট করে খাটের থেকে লঙ্গোঁহিটের ঢাকাটা টেনে নিয়ে তাই দিয়ে মাথাটা মুছে কাপড় ছেড়ে সেটা গায়ে জড়িয়ে বসল। ভাগ্যিস কাশ্মীরি জামিয়ারটা পাতা ছিল না।