পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিশ্বাপরিচয় (Sc. বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের আর কোনো দূতেরই নেই। আমরা ছোটাে পৃথিবীর মানুষ, তাই এতকাল জগতের সব চেয়ে বড়ো চলার কথাটা জািনবার সুযোগ পাইনি। একদিন বিজ্ঞানীদের অত্যাশ্চর্য হিসাবের কলে ধরা পড়ে গেল, আলো চলে সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বেগে । এমন একটা বেগ যা অন্তে লেখা যায়, মনে আনা যায় না। বুদ্ধিতে যার পরীক্ষা হয়, অনুভবে হয় না। আলোর এই চলনের দীেড় অনুভবে বুঝব, এই পৃথিবীটুকুতে এত বড়ো জায়গা পাব কোথায়। এইটুকুর মধ্যে ওর চলাকে আমরা ন-চলার মতোই দেখে আসছি। পরখ করবার মতো স্থান পাওয়া যায় মহাশূন্যে। সূৰ্য আছে সেই জুলুদোলযাত্র দিয়ে সম্ভ কোটি মাইল হােক জ্যোতিষ্কলোকের দূরত্বের মাপকাঠিতে খুব ଅଗଷ୍ଟ । সুতরাং এইটুকু দূরত্বের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ছোটাে মাপে মানুষ আলোর দৌড় দেখতে পেল। খবর মিলল যে, এই শূন্য পেরিয়ে সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসে প্রায় সাড়ে আট মিনিটে। অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টির পাল্লায় সূর্য যখন উপস্থিত, আসলে তার আগেই সে এসেছে। এই আগমনের খবরটি জানাতে আলো-নাকিবের মিনিট আষ্ট্রেক দেরি হল । এইটুকু দেরিতে বিশেষ কিছু আসে যায় না। প্রায় তাজা খবরই পাওয়া গেছে। কিন্তু সৌরজগতের সব চেয়ে কাছে আছে যে নক্ষত্র, অর্থাৎ নক্ষত্রমহলে যাকে আমাদের পাড়াপড়শি বললে চলে, যখন সে জানান দিল “এই-যে আছি তখন তার সেই বার্তা বয়ে আনতে আলোর সময় লাগছে। চার বছরের কাছাকাছি । অর্থাৎ এইমাত্র যে খবর পাওয়া গোল সেটা চার বছরের বাসি। এইখানে দাড়ি টানলেই যথেষ্ট হত, কিন্তু আরো দূরের নক্ষত্র আছে যেখােন থেকে আলো আসতে বহু লক্ষ বছর লাগে । আকাশে আলোর এই চলাচলের খবর বেয়ে বিজ্ঞানে একটা প্রশ্ন উঠল, তার চলার ভঙ্গিটা কী রকম। সেও এক আশ্চৰ্য কথা । উত্তর পাওয়া গেছে তার চলা অতি সূক্ষ্ম ঢেউয়ের মতো। কিসের ঢেউ সে কথা ভেবে পাওয়া যায় না ; কেবল আলোর ব্যবহার থেকে এটা মোটামুটি জানা গেছে। ওটা ঢেউ বটে। কিন্তু মানুষের মনকে হয়রান করবার জন্যে সঙ্গে সঙ্গেই একটা জুড়িখবর তার সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে হাজির হল, জানিয়ে দিলে আলো অসংখ্য জ্যোতিষ্কণা নিয়ে ; অতি খুদে ছিাটগুলির মতো ক্রমাগত তার বর্ষণ। এই দুটাে উলটাে খবরের মিলন হল কোনখানে তা ভেবে পাওয়া যায় না। এর চেয়েও আশ্চর্য একটা পরস্পর উলটাে কথা আছে, সে হচ্ছে এই যে বাইরে যেটা ঘটছে সেটা একটা-কিছু ঢেউ আর বর্ষণ, আর ভিতরে আমরা যা পাচ্ছি তা, না এটা, না। ওটা, তাকে আমরা বলি আলো ; এর মানে কী, কোনো পণ্ডিত তা বলতে পারলেন না । যা ভেবে ওঠা যায় না, যা দেখাশোনার বাইরে, তার এত সূক্ষ্ম এবং এত প্ৰকাণ্ড খবর পাওয়া গোল কী করে, এ প্রশ্ন মনে আসতে পারে। নিশ্চিত প্ৰমাণ আছে, আপাতত এ কথা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। যারা প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন অসাধারণ র্তাদের জ্ঞানের তপস্যা, অত্যন্ত দুৰ্গম ঠাদের সন্ধানের পথ। তাদের কথা যাচাই করে নিতে যে বিদ্যাবুদ্ধির দরকার, তাও আমাদের অনেকের নেই। অল্প বিদ্যা নিয়ে অবিশ্বাস করতে গেলে ঠকতে হবে। প্রমাণের রাস্তা খোলাই আছে। সেই রাস্তায় চলাবার সাধনা যদি কর, শক্তি যদি হয়, তবে একদিন এ-সব বিষয় নিয়ে সওয়ালজবাব সহজেই হতে পারবে । আপাতত আলোর ঢেউয়ের কথাই বুঝে নেওয়া যাক। এই ঢেউ একটিমাত্র ঢেউয়ের ধারা নয়। এর সঙ্গে অনেক ঢেউ দল বেঁধেছে। কতকগুলি চোখে পড়ে, অনেকগুলি পড়ে না। এইখানে বলে রাখা ভালো, যে আলো চোখে পড়ে না, চলতি ভাষায় তাকে আলো বলে না । কিন্তু দৃশ্যই হােক, অদৃশ্যই হােক, একটা-কোনো শক্তির এই ধরনের ঢেউখেলিয়ে চলাই যখন উভয়েরই স্বভাব তখন বিশ্বতত্ত্বের বইয়ে ওদের পৃথক নাম অসংগত। বড়োভাই নামজাদা, ছোটােভাইকে কেউ জানে না, তবু বংশগত ঐক্য ধরে উভয়েরই থাকে একই উপাধি, এও তেমনি । আলোর ঢেউয়ের আপনি দলের আরো একটি ঢেউ আছে, সেটা চোখে দেখি নে, স্পর্শে বুঝি । সেটা তাপের ঢেউ। সৃষ্টির কাছে তার খুবই প্ৰতাপ। এমনিতরো আলোর-ঢেউজাতীয় নানা পদার্থের