পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিশ্বপরিচয় (a সেখানে জোয়ারভাটা খেলতে থাকে ; আর শুনেছি। আমাদের শরীরের ত্বরাজারি বাতের ব্যথাও ঐ টানের জোরে জেগে ওঠে। বাতের রোগীরা ভয় করে অমাবস্যা-পূর্ণিমাকে। আদিকালে পৃথিবীতে জীবনের কোনো চিহ্নই ছিল না। প্রায় সত্তর-আশি কোটি বছর ধরে চলেছিল । নানা আকারে তেজের উৎপাত। কোথাও অগ্নিগিরি ফুসছে তপ্ত বাষ্প, উগরে দিচ্ছে তরল ধাতু, ফোয়ারা ছোটাচ্ছে গরম জলের । নীচের থেকে ঠেলা খেয়ে কঁপিছে ফাঁটছে ভূমিতল, উঠে পড়ছে পাহাড় পর্বত, তলিয়ে যাচ্ছে ভূখণ্ড । পৃথিবীর শুরু থেকে প্রায় দেড়শো কোটি বছর যখন পার হল তখন অশান্ত আদিযুগের মাথা-কুট-মরা অনেকটা থেমেছে। এমন সময়ে সৃষ্টির সকলের চেয়ে আশ্চৰ্য ঘটনা দেখা দিল। কেমন করে কোথা থেকে প্রাণের ও তার পরে ক্রমশ মনের উদভব হল তার ঠিকানা পাওয়া যায় না। তার আগে পৃথিবীতে সৃষ্টির কারখানাঘরে তোলাপাড়া ভাঙাগড়া চলছিল প্রাণহীন পদার্থ নিয়ে। তার উপকরণ ছিল মাটি জল, লোহাপাথর প্রভৃতি ; আর সঙ্গে সঙ্গে ছিল অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন প্রভৃতি কতকগুলি গ্যাস। নানা রকমের প্রচণ্ড আঘাতে তাদেরই উলটাপালট করে জোড়াতাড়া দিয়ে নদী-পাহাড়-সমুদ্রের রচনা ও অদলবদল চলছিল। এমন সময়ে এই বিরাট জীবহীনতার মধ্যে দেখা দিল প্ৰাণ, আর তার সঙ্গে মন । এদের পূর্ববতী পদার্থরাশির সঙ্গে এর কোনোই মিল নেই। নক্ষত্রদের প্রথম আরম্ভ যেমন নীহারিকায় তেমনি পৃথিবীতে জীবলোকে প্রথম যা প্রকাশ পেল তাকে বলা যেতে পারে প্রাণের নীহারিকা। সে একরকম অপরিস্ফুট ছড়িয়ে-পড়া প্ৰাণপদার্থ, ঘন লালার মতো অঙ্গবিভাগহীন- তখনকার ঈষৎ-গরম সমুদ্রািজলে ভেসে বেড়াত। তার নাম দেওয়া হয়েছে প্রোটােপ্লাজম। যেমন নক্ষত্র দানা বেঁধে ওঠে আগ্নেয় বাম্পে, তেমনি বহুযুগ লাগল এর মধ্যে মধ্যে একটি একটি পিণ্ড জমতে । সেইগুলির এক শ্রেণীর নাম দেওয়া হয়েছে অমীবা ; আকারে অতি ছোটাে ; অণুবীক্ষণ দিয়ে দেখা যায়। পন্ধিল জলের ভিতর থেকে এদের পাওয়া যেতে পারে। এদের মুখ চক্ষু হাত পা নেই। আহারের খোজে ঘুরে বেড়ায় । দেহপিণ্ডের এক অংশ প্রসারিত করে দিয়ে পায়ের কাজ করিয়ে নেয়। খাবারের সম্পর্কে এলে সেই সাময়িক পা দিয়ে সেটাকে টেনে নেয় । পাকযাত্র বানিয়ে নেয় দেহের একটা অংশে। নিজের সমস্ত দেহটাকে ভাগ করে তার বংশবৃদ্ধি হয় । এই অমীবারই আর-এক শাখা দেখা দিল, তারা দেহের চারি দিকে আবরণ বানিয়ে তুললে, শামুকের মতো। সমুদ্রে আছে। এদের কোটি কোটি সূক্ষ্ম দেহ। এদের এই দেহপঙ্ক জমে জমে পৃথিবীর স্থানে স্থানে খড়িমাটির পাহাড় তৈরি হয়েছে। বিশ্বরচনার মূলতম উপকরণ পরমাণু; সেই পরমাণুগুলি অচিন্তনীয় বিশেষ নিয়মে অতিসূক্ষ্ম জীবকোষারূপে সংহত হল। প্রত্যেক কোষটি সম্পূর্ণ এবং স্বতন্ত্র, তাদের প্রত্যেকের নিজের ভিতরেই একটা আশ্চর্য শক্তি আছে, যাতে করে বাইরে থেকে খাদ্য নিয়ে নিজেকে পুষ্ট, অনাবশ্যককে ত্যাগ ও নিজেকে বহুগুণিত করতে পারে। এই বহুগুণিত করার শক্তি দ্বারা ক্ষয়ের ভিতর দিয়ে মৃত্যুর ভিতর দিয়ে প্রাণের ধারা প্রবাহিত হয়ে চলে। এই জীবাণুকোষ প্ৰাণলোকে প্ৰথমে একলা হয়ে দেখা দিয়েছে। তার পরে এরা যত সংঘবদ্ধ হতে থািকল ততই জীবজগতে উৎকর্ষ ও বৈচিত্র্য ঘটতে লাগল। যেমন বহুকোটি তারার সমবায়ে একটি নীহারিকা তেমনি বহুকোটি জীবকোষের সমাবেশে এক-একটি দেহ। বংশাবলীর ভিতর দিয়ে এই দেহজগৎ একটি প্রবাহ সৃষ্টি করে নূতন নূতন রূপের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়ে চলেছে। আমরা এত কাল নক্ষত্ৰলোক সূর্যলোকের কথা আলোচনা করে এসেছি। তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আশ্চর্য এই প্ৰাণলোক। উদাম তেজকে শান্ত করে দিয়ে ক্ষুদ্রায়তন গ্রাহরূপে পৃথিবী যে অনতিক্ষুব্ধ পরিণতি লাভ করেছে। সেই অবস্থাতেই প্ৰাণ এবং তার সহচর মান-এর আবির্ভাব সম্ভবপর হয়েছে। এ কথা যখন চিন্তা করি। তখন স্বীকার করতেই হবে জগতে এই পরিণতিই শ্ৰেষ্ঠ পরিণতি। যদিও প্রমাণ নেই এবং প্রমাণ