পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলাভাষা-পরিচয় । (¢ዓw9 গড়ে তুলেছে; মানুষের মনের ঝোঁক, হৃদয়ের আবেগ সেহগুলোকে ঠেলা দিয়ে দিয়ে নানা আকার 缸两1 দোয়েল-কোকিলরাও ধ্বনি দিয়ে ভােব প্রকাশ করে। মানুষের ভাষার ধ্বনি তেমন সহজ নয়। মানুষের অন্য নানা আচরণের মতো প্রত্যেক শিশুকে নতুন করে শুরু করতে হয়েছে ভাষার অভ্যোস, জাগিয়ে রাখতে হয়েছে এর কৌশল । সেইজন্যে মানুষের ভাষা বাধা পড়ে যায় না একই অচল ঠাট । আন্তে আস্তে বদল তার চালেইছে, দু-তিনশো বছর আগেকার ভাষার সঙ্গে পরের ভাষার তফাত ঘটে আসছেই। তবু বিশেষ জাতের ভাষার মূল স্বভাবটা থেকে যায়, কেবল তার আচারের কিছু কিছু বদল হয়ে চলে। সেইজন্যেই প্রাচীন বাংলাভাষা বদল হতে হতে আধুনিক বাংলায় এসে দাড়িয়েছে, অমিল আছে যথেষ্ট, তবু তার স্বভাবের কাঠামোেটাকে নিয়ে আছে তার ঐক্য। ভাষাবিজ্ঞানীরা এই কাঠামোর বিচার করে ভাষার জাত নির্ণয় করেন । সংস্কৃত ব্যাকরণে সমস্ত শব্দেরই এক-একটা মূল ধাতু আন্দাজ করা হয়েছে। সব আন্দাজগুলিই সম্পূর্ণ সত্য হােক বা না হােক, এর গোড়াকার তত্ত্বটাকে মানি। প্ৰাণজগতে প্ৰাণীসৃষ্টির আরম্ভে দেখা দেয় একটি একটি করে জীবকোষ, তার পরে তাদেরই সমবায়ে ক্রমে পরিস্ফুট হয়ে উঠতে থাকে অবয়বধারী জীব। এক-একটি জীব এক-একটি বিশেষ কাঠামো নিয়ে তাদের স্বাতন্ত্র্যের ইতিহাস অনুসরণ করে । জীববিজ্ঞানীরা তাদের সেই কাঠামোর ঐক্য থেকে নানা পরিবর্তনের ভিতরেও তাদের শ্ৰেণী নির্ণয় করেন । ভারতবর্ষের কতকগুলি বিশেষ ভাষাকে ভাষাবিজ্ঞানী গৌড়ীয় ভাষা নাম দিয়ে তাদের মেলবন্ধন করেছেন । আমি বাঙালি, মারাঠি ভাষা শুনলে তার অর্থ বুঝতে পারি। নে ; কিন্তু দুটো ভাষাই যে এক জাতের, ভাষাবিজ্ঞানীরা সেটা ধরতে পেরেছেন তাদের কাঠামো থেকে । পুষত্ব ভাষায় কথা কয় পাঠানেরা, ভারতবর্ষের পশ্চিম সীমানা পেরিয়ে ; পূর্ব সীমানায় আমরা বলি বাংলা। কিন্তু দুই ভাষারই কঙ্কাল-সংস্থানের মধ্যে যে ঐক্য আছে তার থেকে বোঝা যায়। এরা আত্মীয় । এই দুই ভাষাতেই বহুসংখ্যক ধ্বনি গড়ে উঠেছে শব্দ হয়ে । একটা মূলস্বভাব তাদের ঐক্য দিয়েছে। শব্দগুলো বিশ্লেষণ করে দেখলে সেই স্বভাবটা ধরা পড়ে। এর থেকে বোঝা যায়, এক-এক জাতির ভাষা তার স্বতন্ত্র খেয়ালের সৃষ্টি নয়। কতকগুলি মূল ধ্বনিসংকেত নিয়ে যারা ভাষার কারবার আরম্ভ করেছিল, তারা ছড়িয়ে পড়েছে নানা দেশে। কিন্তু ধ্বনিসংকেতের আত্মীয়তা ধরা পড়ে তাদের কাছে, ভাষাদৃষ্টির অভিজ্ঞতা যাদের আছে। প্রাচীন যুগের ঘোড়া আর এখনকার ঘোড়ায় প্রভেদ আছে বিস্তর, কিন্তু তাদের কঙ্কালের ছাদ দেখলে বোঝা যায়, তারা এক বংশের । ভাষার মধ্যেও সেই কঙ্কালের ছাদের মিল পেলেই তাদের একজাতীয়তা ধরা পড়ে । ভাষা বানিয়েছে মানুষ, এ কথা কিছু সত্য আবার অনেকখানি সত্য নয়। ভাষা যদি ব্যক্তিগত কোনো মানুষের বা দলের কৃত কাৰ্য হত তা হলে তাকে বানানো বলতুম ; কিন্তু ভাষা একটা সমগ্ৰ জাতের লোকের মন থেকে, মুখ থেকে, ক্রমশই গড়ে উঠেছে। ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর জমিতে ভিন্ন ভিন্ন রকমের গাছপালা যেমন অভিব্যক্ত হয়ে ওঠে, ভাষার মূলপ্রকৃতিও তেমনি। মানুষের বাগযন্ত্র যদিও সব জাতের মধ্যেই একই ছাদের তবু তাদের চেহারায় তফাত আছে, এও তেমনি। বাগযন্ত্রের একটা-কিছু সূক্ষ্ম ভেদ আছে, তাতেই উচ্চারণের গড়ন যায় বদলে। ভিন্ন ভিন্ন জাতের মুখে স্বরবর্গ ব্যঞ্জনবর্ণের মিশ্রণ ঘটবার রাস্তায় তফাত দেখতে পাওয়া যায়। তার পরে তাদের চিন্তার আছে ভিন্ন ভিন্ন ছাচ, তাতে শব্দ জোড়বার ধরন ও ভাষার প্রকৃতি আলাদা করে দেয় । ভাৰ্য প্রথমে আরম্ভ হয় নানারকম দৈবাৎ শব্দসংঘাতে, তার পরে মানুষের দেহমানের স্বভাব অনুসরণ করে সেই সব সংকেতের ধারায় সে ভরে উঠতে থাকে । পথহীন মাঠের মধ্যে দিয়ে যখন একজন বা দু-চারজন মানুষ কোনো-এক সময়ে চলে গেছে, তখন তাদের পায়ের চাপে মাটি ও ঘাস চাপা পড়ে একটা আকস্মিক সংকেত তৈরি হয়েছে। পরবতী পথিকেরা পায়ের তলায় তারই আহবান পায়। এমনি করে পদক্ষেপের প্রবাহে এ পথ চিহ্নিত হতে থাকে। যদি পরিশ্রম বঁাচাবার জন্যে মানুষ এ পথ বানাতে