পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

28 রবীন্দ্র-রচনাবলী এই ভাষার একটা অভ্যোস দেখা যায়, তিন বা ততোধিক অক্ষর ব্যাপী শব্দের দ্বিতীয় বর্ণে হসন্তু লাগিয়ে শেষ অক্ষরে একটা স্বরবর্ণ জুড়ে শব্দটাকে তাল পাকিয়ে দেওয়া। যথা ক্রিয়াপদে ; ছিটকে পড়া, কাৎরে ওঠা, বাৎলে দেওয়া, সঁাৎরে যাওয়া, হনাহনিয়ে চলা, বদলিয়ে দেওয়া, বিগড়িয়ে যাওয়া। বিশেষ্যপদে : কাংলা ভেটকি কঁকড়া শামলা ন্যাকড়া চামচে নিমকি চিমটি টুকরি কুনকে আঞ্চল কঁচুকলা সকড়ি দেশলাই চামড়া মািট্রকোঠা পাগলা পলতা চালতে গামলা আমলা। বিশেষণ, যেমন : পুঁচুকে বোিটকা আলগা ছুটকো হালকা বিধাকুটে পাৎলা ডানপিটে শুটুকো পনস চিমসে । এই হসন্তবর্ণের প্রভাবে আমাদের চলতি ভাষায় যুক্তবর্ণের ধ্বনিরই প্রাধান্য ঘটেছে। আরো গোড়ায় গেলে দেখতে পাই, এটা ঘটতে পেরেছে। অকারের প্রতি ভাষার উপেক্ষাবশত । সংস্কৃত ভাষার উচ্চারণের সঙ্গে বাংলা উচ্চারণ মিলিয়ে দেখলে প্রথমেই কানে ঠেকে আ স্বরবর্ণ নিয়ে। সংস্কৃত আ স্বরের হ্রস্বরূপ সংস্কৃত অ্য। বাংলায় এই হ্রস্ব আ অর্থাৎ অ, আমাদের উচ্চারণে আ নাম নিয়েই আছে ; যেমন : চালা কঁচা রাজা । এ-সব আ এক মাত্রার চেয়ে প্রশস্ত নয়। সংস্কৃত আকারযুক্ত শব্দ আমরা হ্রস্বমাত্রাতেই উচ্চারণ করি, যেমন ‘কামনা । বাংলা বর্ণমালার অ সংস্কৃত স্বরবর্ণের কোঠায় নেই। ইংরেজি star শব্দের a সংস্কৃত আ, ইংরেক্তি stir শব্দের ; সংস্কৃত অ্য। ইংরেজি ball শব্দের a বাংলা অ্য। বাংলায় ‘অল্পসল্পর বানান যাই হােক, ওর চারটি বর্ণেই সংস্কৃত আ নেই। হিন্দিতে সংস্কৃত অ আছে, বাংলা অ নেই। এই নিয়েই হিন্দুস্থানি ওস্তাদের বাঙালি শাকরেদর উচ্চ অঙ্গের সংগীতে বাংলা ভাষাকে অস্পৃশ্য বলে গণ্য করেন । বাংলা অ যদিও বাংলাভাষার বিশেষ সম্পত্তি তবু এ ভাষায় তার অধিকার খুবই সংকীর্ণ। শব্দের আরম্ভে যখন সে স্থান পায় তখনই সে টিকে থাকতে পারে। ‘কলম’ শব্দের প্রথম বর্ণে অ আছে, দ্বিতীয় বর্ণে সে 'ও' হয়ে গেছে, তৃতীয় বর্ণে সে একেবারে লুপ্ত। ঐ আদিবর্ণের মর্যাদা যদি সে অব্যাঘাতে পেত তা হলেও চলত, কিন্তু পদে পদে আক্রমণ সইতে হয়, আর তখনই পরাস্ত হয়ে থাকে। ‘কলম, যেই হল "কলমি, অমনি প্রথম বর্ণের অকার বিগড়িয়ে হল ও। শব্দের প্রথমস্থিত অকারের এই ক্ষতি বারে বারে নানা রূপেই ঘটছে, যথা : মন বন ধন্য যক্ষ হরি মধু মসৃণ। এই শব্দগুলিতে আদ্য অকার ‘ও’ স্বরকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। দেখা গেছে, ন বর্ণের পূর্বে তার এই দুৰ্গতি, ক্ষ বা ঋ ফলার পূর্বেও তাই। তা ছাড়া দুটি স্বরবর্ণ আছে। ওর শত্ৰু, ই আর উ। তারা পিছনে থেকে ঐ আদ্য আকে করে দেয় ও, যেমন : গতি ফণী বধু যদু। য ফলার পূর্বেও অকারের এই দশা, যেমন : কল্য মদ্য পণ্য বন্য । যদি বলা যায়। এইটেই স্বাভাবিক তা হলে আবার বলতে হয়, এ স্বভাবটা সর্বজনীন নয়। পূর্ববঙ্গের রসনায় অকারের এ বিপদ ঘটে না। তা হলেই দেখা যাচ্ছে, অকারকে বাংলা বর্ণমালায় স্বীকার করে নিয়ে পদে পদে তাকে অশ্রদ্ধা করা হয়েছে বাংলাদেশের বিশেষ অংশে । শব্দের শেষে হসন্ত তাকে খেদিয়েছে, শব্দের আরম্ভে সে কেবলই তাড়া খেতে থাকে। শব্দের মাঝখানেও অকারের মুখোশ পারে ওকারের একাধিপত্য, যথা : খড়ম বালক আদর বান্দর কিরণ টােপর চাকর বাসন বাদল বছর শিকড় আসল মঙ্গল সহজ । বিপদে ওর একমাত্র রক্ষা সংস্কৃত ভাষার করপেক্ষপে, যেমন : অ-মল বি-জন নী-রস কু-রঙ্গ স-বল দুরবল অন-উপম প্রতি-পদ । এই আশ্রয়ের জোরও সর্বত্র । খাটে নি, যথা : বিপদ বিষম সকল । মধ্যবর্ণের অকার রক্ষা পায় য় বর্ণের পূর্বে, যথা : সময় মলয় আশয় বিষয় । মধ্যবর্ণের অকার ওকার হয়, সে-যে কেবল হসন্ত শব্দে তা নয়। আকারান্ত এবং যুক্তবর্ণের পূর্বেও এই নিয়ম, যথা : বসন্ত আলস্য লবঙ্গ সহস্ৰ বিলম্ব স্বতন্ত্র রচনা রটনা যোজনা কল্পনা বঞ্চনা ; ইকার আর উকার পদে পদে অকারকে অপদস্থ করে থাকে তার আরো প্ৰমাণ আছে { সংস্কৃত ভাষায় ঈয় প্রত্যয়ের যোগে ‘জলি’ হয় "জলীয় । চলতি বাংলায় ওখানে আসো উআ প্রতায় : জল-4-উআ=িজলুআ । এইটি হল প্রথম রূপ । কিন্তু উ স্বরবর্ণ শব্দটাকে স্থির থাকতে দেয় না। তার বা দিকে আছে বাংলা অ, ডান দিকে আছে