পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(Sbr রবীন্দ্র-রচনাবলী দৃষ্টান্ত আছে, যেমন : সেদ্ধো (সিদ্ধ), নেত্তো (নিত্য বা নৃত্য), কেষ্টো (কিক্টো), শেকোল (শিকল। বেরোদ (বৃহৎ), খেস্টান ( খুন্টান)। প্রথম বৰ্ণকে ডিঙিয়ে মাঝখানের বর্ণে একার লাফ দিয়েছে সেও লক্ষ্য করবার বিষয়, যেমন : নিথোস বিশ্বেস, সরেস (সরস), নিরেস। ঈশেন বিলেত বিকেল আদেষ্ট । স্বরবর্ণের খেয়ালের আর-একটা দৃষ্টান্ত দেখানো যাক - ‘পিটানো’ শব্দের প্রথম বর্ণের ইকার যদি অবিকৃত থাকে তা হলে দ্বিতীয় বর্ণের আকারকে দেয়। ওকার করে, হয় “পিটােনো । ইকার যদি বিগড়ে গিয়ে একার হয় তা হলে আকার থাকে নিরাপদে, হয়। “পেটানো । তেমনি : মিটানো==মেট্রানো, বিলোনো = বেলানো, কিলোনো=কোলানো। ইকার একারে যেমন অদল-বদলের সম্বন্ধ তেমনি উকারে ওকারে । শব্দের প্রথম বর্ণেউ যদি খাটি থাকে। তা হলে দ্বিতীয় বর্ণের"অকারকে পরাস্ত করে করবে ওকার। যেমন “ভুলানো হয়ে থাকে "ভূলোনো । কিন্তু যদি ঐ উকারের শ্বলন হয়ে হয় ওকার তা হলে আকারের ক্ষতি হয় না, তখন হয় ‘ভোলানো তেমনি : ডুবোনো = ডোবানো, ছুটোনো = ছোেটানো । কিন্তু 'ঘুমোনো কখনোই হয় না। ‘ঘোমানে', ‘কুলোনাে হয় না ‘কোলানাে কেন। অকৰ্মক বলে কি ওর স্বতন্ত্র বিধান। দেখা যাচ্ছে বাংলা উচ্চারণের ইকার এবং উকার খুব কমিষ্ঠ, একার এবং ওকার ওদের শরণাগত বাংলা অকার এবং আকার উৎপাত সইতেই আছে। স্বরবর্ণের কোঠায় আমরা ঝাঁকে ঋণস্বরূপে নিয়েছি। বর্ণমালায়, কিন্তু উচ্চারণ করি ব্যঞ্জনবর্ণেররি। সেইজন্যে অনেক বাঙালি ‘মাতৃভূমিকে বলেন মাত্রিভূমি । যে কবি তার ছন্দে ঋকারকে স্বরবর্ণরূপে ব্যবহার করেন তার ছন্দে ঐ বর্ণে অনেকের রসনা ঠোকর খায়। সাধারণত বাংলায় স্বরের দীর্ঘ উচ্চারণ নেই। তবু কোনো কোনো স্থলে স্বরের উচ্চারণ কিছু পরিমাণে বা সম্পূর্ণ পরিমাণে দীর্ঘ হয়ে থাকে। হসন্ত বর্ণের পূর্ববর্তী স্বরবর্ণের দিকে কান দিলে সেটা ধরা পড়ে, যেমন 'জল' । এখানে জ'এ যে অকার আছে তার দীর্ঘতা প্ৰমাণ হল "জলা’ শব্দের জ'এর সঙ্গে তুলনা করে দেখলে। ‘হাত’ আর "হাতায় প্রথমটির হা দীর্ঘদ্বিতীয়টির হ্রস্ব । ‘পিঠি' আর ‘পিঠি', “ভূত' আর "ভূতো’, ‘ঘোল আর ‘ঘোলা- তুলনা করে দেখলে কথাটা স্পষ্ট হবে। সংস্কৃতে দীর্ঘস্বরের দীর্ঘতা সর্বত্রই, বাংলায় স্থানবিশেষে । কথায় ঝোক দেবার সময় বাংলা স্বরের উচ্চারণ সব জায়গাতেই দীর্ঘ হয়, যেমন : ভা—রি তো পণ্ডিত, কে-বা কার খোজ রাখে, আ-জই যাব, হল-ই বা, অবা-কি করলে, হাজা-রো লোক, কী-যে বকো, এক ধা-র থেকে লােগা-ও মার। যুক্তবর্ণের পূর্বে সংস্কৃতে স্বর দীর্ঘ হয়, বাংলায় তা হয় না। বাংলায় একটা অতিরিক্ত স্বরবর্ণ আছে যা সংস্কৃত ভাষায় নেই। বর্ণমালায় সে ঢুকেছে একারের নামের ছাড়পত্র নিয়ে, তার জন্যে স্বতন্ত্র আসন পাতা হয় নি । ইংরেজি bad শব্দের a তার সমজাতীয় । বাংলায় তার বিশেষ বানান করবার সময় আমরা য ফলায় আকার দিয়ে থাকি । বাংলায় আমরা যেটাকে বলি অন্ত্যন্থ যাঁ, চা বর্গের জ'এর সঙ্গে তার উচ্চারণের ভেদ নেই । য’এর নীচে ফোট দিয়ে আমরা আর-একটা অক্ষর বানিয়েছি তাকে বলি ইয়। সেটাই সংস্কৃত অন্ত্যন্থ য। সংস্কৃত উচ্চারণ মতে 'যম' শব্দ য়ম । কিন্তু ওটাতে ‘জম উচ্চারণের অজুহাতে য়াির ফোটা দিয়েছি সরিয়ে । “নিয়ম" শব্দের বেলায় য়াির ফোটা রক্ষে করেছি, তার উচ্চারণেও সংস্কৃত বজায় আছে। কিন্তু যফলা-আকারে (ব্যা) য়কে দিয়েছি খেদিয়ে আর আটকে দিয়েছি বঁকা করে। সংস্কৃতে ‘ন্যাস’ শব্দের উচ্চারণ নিয়াস, বাংলায় হল nas । তার পর থেকে দরকার পড়লে য ফলার চিহ্নটাকে ব্যবহার করি আকারটাকে বাকিয়ে দেবার জন্যে। Paris শব্দকে বাংলায় লিখি “প্যারিস, সংস্কৃত বানানের নিয়ম অনুসারে এর উচ্চারণ হওয়া উচিত ছিল “পিয়ারিস । একদা ন্যায় শব্দটাকে বাংলায় “নেয়ায় লেখা হয়েছে দেখেছি । অথচ ন্যায়’ শব্দকে বানানের ছলনায় আমরা তৎসম শব্দ বলে চালাই । যিমকেও আমরা ভয়ে ভয়ে বলে থাকি বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দ, অথচ রাসনায় ওটা হয়ে দাঁড়ায় তদ্ভব বাংলা । সংস্কৃত শব্দের একার বাংলায় অনেক স্থলেই স্বভাব পরিবর্তন করেছে, যেমন খেলা, যেমন ‘এক ।