পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলাভাষা-পরিচয় VbY0 সদেশের যোগ্য হয় তা হলে গোপালকেই সন্দেশ দেওয়া যায়। কিন্তু যে বিশেষ্যপদ সাধারণবাচক তার বেলায় কর্মকারকের চিহ্ন কাজে লাগে না, যেমন : রাখাল গোরু চরায় । “গোরুকে চরায় না। ময়রা সন্দেশ বানায়, সন্দেশকে বানায় না । বিপদ এই একটা নিয়মের নাগাল যেই পাওয়া যায় অমনি জুটে যায় অনিয়মের দৃষ্টিান্ত, যথা : যে গাড়োয়ান গোরুকে পীড়ন করে সে তো কশাইয়েরই খুড়তুতো ভাই। এখানে গোরু যদিও সাধারণ বিশেষ্য তবু এখানে কর্মকারকে কে বিভক্তি দ্বারা তার সঙ্গে বিশেষ বিশেষের মতাে ব্যবহার করা হল। বিকে মেরে বীেকে শেখানাে ; এখানে ‘বি’ ‘বীে বিশেষ বিশেষ্য নয়, সাধারণ বিশেষ্য, তবু কে বিভক্তি গ্ৰহণ করেছে। এটা বেআইনি বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আইন আছে প্রচ্ছন্ন হয়ে । রাখাল সাধারণ গোরু চরিয়ে থাকে, সেই তার ব্যবসা । কিন্তু গাড়োয়ান গোরুকে যে পীড়ন করে সে একটা বিশেষ ঘটনানা পিটোতেও পারত। বউয়ের উপকারের জন্যে শাশুড়ি যদি বিকে মারে সে একটা বিশেষ ব্যাপার, মারাটা সাধারণ ঘটনা নয় । বলে থাকি 'ময়রা মালপো তৈরি করে’, ‘মালপোকে তৈরি করে বলিই নে। কিন্তু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলা অসম্ভব নয় যে : ময়রা মালপোকে করে তোলে জুতোর সুকতলা । মালপো তৈরি করা সাধারণ ময়রা কর্তৃক সাধারণ ব্যাপার ; সুকতলার মতো মালপো তৈরি করাটা নিঃসন্দেহ সাধারণ ব্যাপার নয় । সর্বনামের প্রসঙ্গে করণকারকের নিয়ম পূর্বেই বলা হয়েছে। অন্য বিশেষ্যপদ সম্বন্ধেও প্রায় সেই একই কথা । দ্বারা দিয়ে করে ; এই তিনটে শব্দ করণকারকের প্রধান উপকরণ । সর্বনামের সঙ্গে অন্য বিশেষ্যপদের একটা প্ৰভেদ বিভক্তি নিয়ে ; সর্বনামে কে, বিশেষ্যে এ । যথা : হাতে মারা ভালো ভাতে মারার চেয়ে, পৃথিবী পুরাবে তুমি ভারতের ধানে। সর্বনামে এই বিভক্তি বিকল্পে য়, যেমন : তোমায় দিয়ে। নিমের দৃষ্টাস্তে কর্মকারকের চিহ্ন দেখি নে, যথা : মন দিয়ে শোনো, হাত দিয়ে খাও, লোক দিয়ে চিঠি পাঠাও । মন দিয়ে কাজ করো, বাজে কাজে হাত দিয়ে না ; এখানে মনও নির্বতন্ত্ৰক, হােতও তাই ; এ হাত দৈহিক হাত নয়, এ হাত বলতে বোঝায় চেষ্টা । লোক দিয়ে চিঠি পাঠাও ; এ লোক কোনো বিশেষ লোক নয়, সাধারণভাবে যাকে হােক কাউকে দিয়ে চিঠি পাঠাবার কথা হচ্ছে। ঘরামি দিয়ে চাল ছাইতে হবে ; এখানে বিকল্পে “ঘরামিকে দিয়েও হয় । কিন্তু ব্যক্তিবাচক বিশেষ্যে কর্মকারকের কে বিভক্তি থাকাই চাই ; রামকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়ো । মানুষ ছাড়া অন্য জীববাচক বিশেষ্য সম্বন্ধেও এই নিয়ম, যেমন : বােদরকে দিয়ে চাষ করানো চলে না, ধোবার গাধাকে দিয়ে ঘোড়দৌড় খেলাবে না কি । করণকারকে করে শব্দ অধিকরণরাপের সঙ্গে যুক্ত হয় : গ্লাসে করে জল খাও, তুলিতে করে আঁকো । করণকারকে “দিয়ে আর “ক”রে’ শব্দে পার্থক্য আছে । ‘পান্ধিতে করে যাওয়া চলে ‘পান্ধি দিয়ে” চলে না। খাবার বেলায় বলি “হাতে করে খাও” ; নেবার বেলায় বলি ‘হাত দিয়ে নাও' । একটাতে হােত হচ্ছে উপায়, আর-একটাতে হাত হচ্ছে আধার। পান্ধিতে করে মানুষ যায়, কিন্তু যায় পথ "দিয়ে' । এখানে পান্ধি উপায়, পথ আধার। কিন্তু অর্থ হিসাবে বিকল্পে হাত উপায়ও হতে পারে, আধারিও হতে পারে। তাই হাত দিয়ে খাও” বলাও চলে, “হাতে করে খাও" বলতেও দোষ নেই। বলে থাকি ; বড়ো রাস্তা দিয়ে যখন যাবে গাড়িতে করে যেয়ো । কোনো সাহেব যদি বলে রাস্তায় করে যাবার সময় গাড়ি দিয়ে যেয়ো, বুঝব সে বাঙালি নয়। লোক দিয়ে পাঠাব চিঠি, লোকটা উপায় ; ব্যাগে করে, সে চিঠি নেবে, ব্যাগটা আধার।