পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পথের সঞ্চয় Vyeo)) আকস্মিক নয়, ব্যক্তিগত নয় ; সমন্ত জাতির বহুদিনের তপস্যার সহিত আধ্যাত্রিক শক্তি ভীষণ পরীক্ষায় মৃত্যুর উপরে জয়লাভ করিল। " এই জাহাজ ডুবিতে একসঙ্গে নিবিড় করিয়া যে শক্তিকে দেখিয়াছি, য়ুরোপে সেই শক্তিকেই কি নানা দিকে নানা আকারে দেখি নাই। দেশহিতের ও লোকহিতের জন্য সর্বস্বত্যাগ ও প্রাণবিসর্জনের দৃষ্টান্ত কি সেখানে প্রত্যহই হাজার হাজার দেখা যায় না। সেই অজস্রাসঙ্কিত পুঞ্জীভূত ত্যাগের দ্বারাই কি য়ুরোপীয় সভ্যতা প্রবাল-দ্বীপের মতো মাথা তুলিয়া উঠে নাই। কোনো সমাজে যথার্থ কোনো উন্নতিই হইতে পারে না যাহারাভিত্তি দুঃখের উপর প্রতিষ্ঠিত নহে। এই দুঃখকে তাহারাই বরণ করিতে পারে না যাহারা মেটেরিয়ালিস্ট, যাহারা জড়বস্তুর দাস। বস্তুতেই যাহাঁদের চরম আনন্দ, বস্তুকে তাহারা ত্যাগ করবে। কেন । কল্যাণকে তাহারা আপনার প্রাণের চেয়ে কেন বড়ো করিয়া স্বীকার করবে। শাস্ত্ৰবিহিত যে পুণ্যকে মানুষ পারলৌকিক বিষয়সম্পত্তিয় মতোই জানে সেই স্বার্থপর পুণ্যের জন্যও সে দুঃখবীকার করিতে পারে- কিন্তু যে পূণ্য শাস্ত্ৰবিধির সামগ্ৰী নহে, যাহা তীর্থযাত্রার দুঃখ নহে, যাহা শুভনক্ষত্ৰযোগের দান নহে, যাহা হৃদয়ের স্বাধীন প্ররোচনা, সেই দুঃখ, সেই মৃত্যুকে কি কখনো কোনো বস্তু-উপাসক গ্ৰহণ করিতে পারে। যুরোপে দেশের জন্য, মানুষের জন্য, জ্ঞানের জন্য, প্রেমের জন্য, হৃদয়ের স্বাধীন আবেগে, সেই দুঃখকে, সেই মৃত্যুকে আমরা প্রতিদিনই বরণ করিতে দেখিয়াছি। ইহার মধ্যে সমস্তটাই খাটি নহে, ইহার মধ্যে অনেকটা আছে যাহা বাহাদুরি, কিন্তু সেই অপবাদ দিয়া সত্যকে খর্ব করিবার চেষ্টা করা উচিত নহে। কোনো কোনো রাত্রে চন্দ্রের চারিদিকে একটা জ্যোতির চক্ৰ দেখা যায় । আমরা জানি, তাহা চন্দ্ৰ নহে, তাহা ছায়া, তাহা মিথ্যা । কিন্তু, চন্দ্র মাঝখানে না থাকিলে সেই চন্দ্রের ভানটুকুও থাকিতে পারে না। সকল সমাজেই যেটি শ্রেষ্ঠ পদার্থতাহাকে ঘিরিয়া, তাহার আলোক ধার করিয়া লইয়া, একটা ভানের মণ্ডল সুজিত হইয়া থাকে । কিন্তু, সেই নকলটা আসলের প্রতিবাদ করে না, তাহারই সমর্থন করে । ভণ্ড সন্ন্যাসীকে দেখিয়া আমাদের দেশের সাধুসন্ন্যাসীকে অবিশ্বাস করিয়া বসিালে ঠকিতে হইবে । য়ুরোপের র্যাহারা অসামান্য লোক তাহদের কথা আমরা বইয়ে পড়িয়াছি, তাহাদিগকে কাছে দেখি নাই। কাছে যে দুই-একজনকে দেখিয়াছি য়ুরোপের জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর মধ্যে র্তাহারা স্থান পান নাই । অনেকদিন হইল একটি সুইডেনের মানুষকে দেখিয়ছিলাম, তঁহার নাম হ্যামারগ্রেন” । তিনি সেই দূরদেশে বসিয়া দৈবক্রমে রামমোহন রায়ের কি একটুকু পরিচয় কোনো একটা বইয়ে পাইয়াছিলেন । ইহাতে তাহার মনে এমন একটি ভক্তি জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছিল যে, তাহার দারিদ্র্য সত্ত্বেও দেশ ছাড়িয়া তিনি বহু কষ্ট সমুদ্র পার হইয়া এই বাংলাদেশে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এখানকার ভাষা জানিতেন না, মানুষকে চিনিতেন না, তবু বাঙালির বাড়িতেই আশ্রয় লইয়া এই রামমোহন রায়ের দেশকেই তিনি বরণ করিয়া লইলেন । যে অল্প কয়দিন বাচিয়াছিলেন, কী দুঃসহ ক্লেশ সহ্য করিয়া, কী নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে, অথচ কী সম্পূৰ্ণ নম্রতার মধ্যে নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখিয়া, তিনি এই দেশের হিতের জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করিয়াছিলেন, তাহা যাহারা দেখিয়াছেন তাহারা কখনোই ভুলিতে পারবেন। না। নিমতলার ঘাটে তাহার মৃতদেহ দাহ করা হইয়াছিল ; তদুপলক্ষে, হিন্দুর শ্মশান কলুষিত করা হইল বলিয়া, আমাদের কোনো সাপ্তাহিক পত্র ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছিল। ভগিনী নিবেদিতাৰ স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি ভক্তি বহন করিয়া কিরূপ অদ্ভুত আত্মত্যাগের দ্বারা ভারতবর্ষের নিকট আপনাকে উৎসর্গ করিয়াছিলেন, তাহা কাহারও অবিদিত নাই । এই দুই দৃষ্টান্তেই আমরা দেখিয়াছি, এই দুটি ভক্ত এমন স্থানে এমন অবস্থার মধ্যে আত্মদান করিয়াছেন যেখানে তঁহাদের জীবনের কোনো পৰ্যাভ্যন্ত সহজ পথ। তাহদের সম্মুখে ছিল না ; যেখানে ১ ফ্ৰইবা ; বিদেশীয় অতিথি এবং দেশীয় আতিথ্য, রবীন্দ্র রচনাবলীর বাদশ খণ্ড (সুলভ ব্য)। ২ দ্রষ্টব্য ; ‘ভগিনী নিবেদিত রবীন্দ্র-রচনাবলীর অষ্টাদশ খণ্ড (সুলভ নবম)।