পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

èy8S রবীন্দ্র-রচনাবলী আকর্ষণের ভিতর দিয়া প্রাণীদের প্রাণসম্পদ আজ আশ্চর্যরূপে উৎকর্ষলাভ করিয়াছে, তেমনি মানুষের প্রকৃতিও কেহ বা স্থিতিকে কেহ বা গতিকে বিশেষভাবে আশ্রয় করাতেই আজ আমরা এমন একটি মিলনকে আশা করিতেছি, মানুষের সভ্যতাকে যাহা বিচিত্রভাবে সার্থক করিয়া তুলিবে। আরব-সমুদ্র ১৬ জ্যৈষ্ঠ বুধবার । ১৩১৯ সমুদ্রপাড়ি বন্দর পার হইয়া জাহাজে গিয়া উঠিলাম। আরো অনেকবার জাহাজ চড়িয়াছি। প্রত্যেক বারেই প্রথমটা কেমন মনের মধ্যে একটা সংকোচ উপস্থিত হয় । সে সংকোচ অপরিচিত স্থানে অপরিচিত মানুষের মধ্যে প্রবেশ করবার সংকোচ নহে। জাহাজটার সঙ্গে নিজের জীবনের বিচ্ছেদ অত্যন্ত বেশি করিয়া অনুভব করি। এ জাহাজ যাহারা গড়িয়ছে, যাহারা চালাইতেছে, তাহারাই এ জাহাজের প্রভুআমি টাকা দিয়া টিকিট কিনিয়া এখানে স্থান পাইয়াছি। এই সমূদ্রের চিহ্নহীন পথের উপর দিয়া কত বংশ ধরিয়া ইহাদের কত নাবিক। আপনার জীবনের অদৃশ্য রেখা রাখিয়া গিয়াছে ; বারংবার কত শত মৃত্যুর দ্বারা তবে এই পথ ক্রমে সরল হইয়া উঠিতেছে। আমি যে আজ এই জাহাজে দিনে নিৰ্ভয়ে আহার বিহার করিতেছি ও রাত্রে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইতেছি, এই নিৰ্ভয়তা কি শুধু টাকা দিয়া কিনিবার জিনিস। ইহার পশ্চাতে স্তরে স্তরে কত চিন্তা কত সাহসের সঞ্চয় সমুচ্চ হইয়া রহিয়াছে ; সেখানে আমাদের কোনো অর্ঘ্য জমা হয় নাই । যখন এই ইংরেজ স্ত্রীপুরুষদের দেখি, তাহারা ডেকের উপর খেলিতেছে, ঘুমাইতেছে, হাস্যালাপ করিতেছে, তখন আমি দেখিতে পাই- ইহারা তো কেবলমাত্র জাহাজের উপরে নাই, ইহাৱা স্বজাতির শক্তির উপর নির্ভর করিয়া আছে। ইহারা নিশ্চয় জানে যাহা করিবার তাহ করা হইয়াছে এবং যাহা করিবার তাহ করা হইবে, সেজন্য ইহাদের সমস্ত জাতি জামিন রহিয়াছে। যদি প্ৰাণসংশয়-সংকট উপস্থিত হয় তবে কেবল যে কাপ্তেন আছে তাহা নহে, ইহাদের সমস্ত জাতির প্রকৃতিগত উদ্যম ও নিরলস সতর্কতা শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে। ইহারা সেই দৃঢ় ক্ষেত্রের উপর এমন প্রফুল্লমুখে প্রসন্নচিত্তে সঞ্চারণ করিতেছে, চারি দিকের তরঙ্গের প্রতি ভূক্ষেপ করিতেছে না। এই জায়গায় ইহারা নিজেরা যাহা দিয়াছে তাঁহাই পাইতেছে- আর আমরা যাহা দিই নাই তাঁহাই লইতেছি ; সুতরাং সমুদ্র পার হইতে হইতে দেন। রাখিয়া রাখিয়া যাইতেছি। তাই জাহাজে ডেকের উপরে ইংরেজ যাত্রীদের সঙ্গে একত্র মিলিয়া বসিতে আমার মন হইতে কিছুতে সংকোচ ঘূচিতে চায় না। ডাঙায় বসিয়া অনেক বিলাতি জিনিস ব্যবহার করিয়া থাকি, সেজন্য মনের মধ্যে এমনতরো দৈন্য বোধ হয় না ; জাহাজে আমরা আরো যেন কিছু বেশি লাইতেছি। এ তো শুধু কলকারখানা নয়, সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আছে। জাহাজ যাহারা চালাইতেছে তাহারা নিজের সাহস দিয়া, শক্তি পার করিতেছে ; তাহাদের যে মনুষ্যত্বের উপর ভর দিয়া আছি নিজেদের মধ্যে তাঁহারই যদি কোনো পরিচয় থাকিত তবে যে টাকাটা দিয়া টিকিট কিনিয়াছি তাহার ঝমােঝমানির সঙ্গে অন্য মূল্যের আওয়াজটাও মিশিয়া থার্কিত। আজ মনের মধ্যে এই বড়ো একটা বেদনা বাজে যে, উহারা প্ৰাণ দিয়া চালাইতেছে আর আমরা টাকা দিয়া চলিতেছি, ইহার মাঝখানে যে একটা প্ৰকাণ্ড সমুদ্র পড়িয়া রহিল তাহা আমরা করে কোন কালে পার হইতে পারিব ! এখনো আরম্ভ করা হয় নাই, এখনো অকাতরে কত প্ৰাণ দেওয়া বাকি রহিয়াছে- এখনো কত বন্ধন হিড়িতে হইবে, কত সংস্কার দলিতে হইবে, সে কথা যখন ভাবি