পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

test রবীন্দ্র-রচনাবলী সাধন করিয়া তুলিতেছে। কিন্তু, তবুও শক্তির সীমা আছে। বাতিও খুব বড়ো করিয়া জ্বালাইৰ সলিতাও ক্ষয় করিব না, এ তো কোনোমতেই হয় না। এইজন্য পাশ্চাত্যদেশে জীবনযাত্রার দাবি এক দিকে যত বাড়িতেছে আর-এক দিকে ততই সোদ করিতেছে। আরামকে সুবিধাকে কোথাও খর্ব করিব না পণ করিয়া বসাতে তাহার বােঝা,কেবল প্ৰকাণ্ড বড়ো হইয়া উঠিতেছে। এই বোঝা তো কোনো একটা জায়গায় চাপ দিতেছে। যেখানে সেই চাপ পড়িতেছে সেখানে যে পরিমাণে দুঃখ জমিতেছে সে পরিমাণে ক্ষতিপূরণ হইতেছে না। এইজন ভার-সামঞ্জস্যের প্রয়াস আগ্নেয় ভূমিকম্পের আকারে সমন্ত পীড়িত সমাজের ভিতর হইতে ক্ষণে ক্ষণে মাথা তুলিবার উপক্ৰম করিতেছে। মানুষের সুবিধাকে সৃষ্টি করিবার জন্য কল কেবলই বাড়িয়া চলিতেছে এবং মানুষের জায়গা কল জুড়িয়া বসিতেছে। কোথায় ইহার অন্ত ? মানুষ আপনাকে আপনার অভাবপূরণের যন্ত্র করিয়া তুলিতেছে- কিন্তু, সেই আপনাকে সে পাইবে কোন অবসরে ? যেমন করিয়াই হউক, এক জায়গায় তাহাকে দাড়ি টানিয়া দিয়া বলিতেই হইবে, “এই রহিল আমার উপকরণ, এখন আমাকে আমার উদ্ধার করা চাই । যাহাতে আমার আবশ্যক তাহা আমাকে অবশ্য জোগাইতে হইবে, কিন্তু এ-সমন্তে আমার আবশ্যক নাই ।” অর্থাৎ, মানুষের উদ্যম যখন কেবলই একটানা চলিতে থাকে তখন সে একটা জায়গায় আসিয়া আপনাকে আপনি ব্যর্থ করিয়া বসে। পূর্ণতার পথ সোজা পথ নহে। সেইজন্য আজ য়ুরোপের যাহা বেদনা আমাদের বেদনা কখনোই তাহা নহে। যুরোপ তাহার দেহকে সম্পূর্ণ করিয়া তাহার মধ্যে আত্মাকে প্রতিষ্ঠা করিতে চাহিতেছে। আমাদের আত্মা দেহ হারাইয়া প্রেতের মতো পৃথিবীতে নিম্ফল হইয়া ফিরিতেছে। সেই আত্মার বাহ্য প্রতিষ্ঠা কোথায় । তাহার মধ্যে যে ঈশ্বরের সাধৰ্ম আছে, সে আপনার ঐশ্বর্য বিস্তার না করিয়া বঁাচে না । সে যে আপনাকে নানা দিকে প্রকাশ করিতে চায়রাজ্যে, বাণিজ্যে, সমাজে, শিল্পে, সাহিত্যে, ধর্মে - এখানে সেই প্রকাশের উপকরণ কই ? সেই উপকরণের প্রতি তাহার কর্তৃত্ব কোথায় ? দেখিতেছি, তাহার কলেবর এক জায়গায় যদি বঁধে তো আর-এক জায়গায় আলগা হইয়া পড়ে- ক্ষণকালের জন্য যদি তাহা নিবিড় হইয়া দাড়ায় তবে পরীক্ষণেই বাষ্প হইয়া উড়িয়া যায়। তাই আজ যেমন করিয়াই হউক, আমাদিগকে এই দেহতত্ত্ব সাধন করিতে হইবে ; যেমন করিয়াই হউক, আমাদিগকে এই কথাটা বুঝিতে হইবে যে, কলেবরহীন আত্মা কখনোই সত্য নহে- কেননা, কলেবর আত্মারই একটা দিক । তাহা গতির দিক, শক্তির দিক, মৃত্যুর দিক- কিন্তু তাহারই সহযোগে আত্মার স্থিতি, আনন্দ, অমৃত । এই কলেবর সৃষ্টির অসম্পূর্ণতাতেই আমাদের দেশের শ্ৰীহীন আত্মা শতাব্দীর পর শতাব্দী হাহাকার করিয়া ফিরিতেছে। বাহিরের সত্যকে দূরে ফেলিয়া আমাদের অন্তরাত্মা কেবলই অবাধে স্বল্প সৃষ্টি করিতেছে। সে আপনার ওজন হারাইয়া ফেলিতেছে, এইজন্য তাহার অন্ধ বিশ্বাসের কোনো প্রমাণ নাই, কোনো পরিমাণ নাই; এইজন্য কোথাও বা সত্যকে লইয়া সে মায়ার মতো খেলা করিতেছে, কোথাও বা মায়াকে লইয়া সে সত্যের মতো ব্যবহার করিতেছে । আরব-সমুদ্র ১৭। জ্যৈষ্ঠ ১৩১৯