পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

에 R একদিন মানুষ ছিল বুনো,ঘোড়াও ছিল বনের জন্তু । মানুষ দুটিতে পারিত না, ঘোড়া বাতাসের মতো দুটিত । কী সুন্দর তাহার ভঙ্গি, কী অবাধ তাহার স্বাধীনতা ! মানুষ চাহিয়া দেখিত, আর তাহার ঈর্ষ হইত। সে ভাবিত, ঐরকম বিদ্যুৎগামী চারটি পা যদি আমার খার্কিত তাহা হইলে দূরকে দূর মানিতাম না, দেখিতে দেখিতে দিগদিগন্তর জয় করিয়া আসিতাম। ঘোড়ার সর্বাঙ্গে যে-একটি চুটিবার আনন্দ দ্রুত তালে নৃত্য করিত সেইটের প্রতি মানুষের মনে মনে ভারি একটা লোভ হইল। কিন্তু, মানুষ। শুধু শুধু লোভ করিয়া বসিয়া থাকিবার পাত্র নহে। "কী করিলে ঘোড়ার চারটি পা আমি পাইতে পারি গাছের তলায় বসিয়া এই কথাই সে ভাবিতে লাগিল। এমন অদ্ভুত ভাবনাও মানুষ ছাড়া আর-কেহ ভাবে না। “আমি দুই-পাওয়ালা খাড়া জীব, আমার চার পায়ের সংস্থােন কি কোনোমতেই হইতে পারে। অতএব, চিরদিন আমি এক-এক পা ফেলিয়। ধীরে ধীরে চলিব। আর ঘোড়া তড়বড় করিয়া দুটিয়া চলিবে, এ বিধানের অন্যথা হইতেই পারে না।' কিন্তু, মানুষের অশান্ত मन 6 कथीं (कiनांभाठे भानिक नां । একদিন সে ফাস লাগাইয়া বনের ঘোড়াকে ধরিল। কেশর। ধরিয়া তাহার পিঠের উপর চড়িয়া বসিয়া নিজের দেহের সঙ্গে ঘোড়ার চার পা জুড়িয়া লইল । এই চারটে পাকে সম্পূর্ণ নিজের বিশ করিতে তাহার বহুদিন লাগিয়াছে, সে অনেক পড়িয়াছে, অনেক মরিয়াছে, কিন্তু কিছুতেই দমে নাই । ঘোড়ার গতিবেগকে সে ডাকাতি করিয়া লইবেই এই তাহার পণ । তাঁহারই জিত হইল। মন্দগামী মানুষ দ্রুতগমনকে বধিয়া ফেলিয়া আপনার কাজে খাটাইতে লাগিল । ডাঙায় চলিতে চলিতে মানুষ এক জায়গায় আসিয়া দেখিল সম্মুখে তাহার সমুদ্র, আর তো এগোইবার জো নাই। নীল জল, তাহার তল কোথায়, তাহার কুল দেখা যায় না। আর, লক্ষ লক্ষ ঢেউ তর্জনী তুলিয়া ডাঙার মানুষদের শাসাইতেছে ; বলিতেছে, “এক পা যদি এগোও তবে দেখাইয়া দিব, এখানে তোমার জারিজুরি খাটিবে না !” মানুষ তীরে বসিয়া এই অকুল নিষেধের দিকে চাহিয়া রহিল। কিন্তু, নিষেধের ভিতর দিয়া একটা মন্ত আহবানও আসিতেছে। তরঙ্গগুলা অট্টহাস্যে নৃত্যু করিতেছে- ডাঙার মাটির মতো কিছুতেই তাহাদিগকে বধিয়া রাখিতে পারে নাই। দেখিলে মনে হয়, লক্ষ লক্ষ ইস্কুলের ছেলে যেন ছুটি পাইয়াছে- চীৎকার করিয়া, মাতামতি করিয়া, কিছুতেই তাহদের আশ মিটিতেছে না ; পৃথিবীটাকে তাহারা যেন ফুটবলের গোলার মতো লাথি ষ্টুড়িয়া ষ্টুড়িয়া আকাশে উড়াইয়া দিতে চায়। ইহা দেখিয়া মানুষের মন তীরে বসিয়া শান্ত হইয়া পড়িয়া থাকিতে পারে না। সমুদ্রের এই মাতুনি মানুষের রক্তের মধ্যে করতাল বাজাইতে থাকে। বাধাহীন জলরাশির এই দিগন্তবিস্তৃত মুক্তিকে মানুষ আপন করিতে চায়। সমুদ্রের এই দূরত্বজয়ী আনন্দের প্রতি মানুষ লোভ দিতে লাগিল। ঢেউগুলার মতো করিয়াই দিগন্তকে লুঠ করিয়া লইবার জন্য মানুষের কামনা। কিন্তু, এমন অদ্ভুত সাধামিটবে কী করিয়া ; এই তীরের রেখাটা পর্যন্ত মানুষের অধিকারের সীমাতাহার সমন্ত ইচ্ছােটাকে এই দাড়ির কাছে আসিয়া শেষ করিতে হইবে । কিন্তু, মানুষের ইচ্ছাকে যেখানে শেষ করিতে চাওয়া যায়। সেইখানেই সে উচ্ছসিত হইয়া উঠে। কোনোমতেই সে বাধাকে চরম বলিয়া মানিতে চাহিল না। অবশেষে একদিন বুনো ঘোড়াটার মতোই সমুদ্রের ফেনকেশর। ধরিয়া মানুষ তাহার পিঠের উপর চড়িয়া বসিল+ কুদ্ধ সাগর পিঠ নাড়া দিল ; মানুষ কত ডুবিল, কত মরিল, তাহার সীমা নাই। অবশেষে একদিন মানুষ এই অবাধ্য সাগরকেও আপনার সঙ্গে জুড়িয়া লইল । তাহার এক কুল হইতে আর-এক কুল পর্যন্ত মানুষের পায়ের কাছে আসিয়া মাথা ঠোঁট করিয়া দিল। বিশাল সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষটা যে কিরকম, আজ আমরা জাহাজে চড়িয়া তাহাই অনুভব করিতেছি। আমরা তো এই একটুখানি জীব, তরুণীর এক প্রান্তে চুপ করিয়া দাড়াইয়া আছি, কিন্তু দূর দূর বহুদূর পর্যন্ত সমন্ত আমার সঙ্গে মিলিয়াছে। যে দূরকে আজ রেখামাত্রও দেখিতে পাইতেছি না।