পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(S রবীন্দ্র-রচনাবলী জোর আশ্ৰয় করিতে হয়। তখন দুর্বলের মিথ্যাচার ও প্রবলের দীেরাত্ম্যে সমাজ লণ্ডভণ্ড হইতে 邸1 এমনি করিয়াই পাপ আসে, বিনাশ আসে। কিন্তু, এই পাপ যদি না আসিত তবে মানুষ পথ দেখিতে পাইত না। এই আরোর অতৃপ্তি যেখানে তাহাকে টানিয়া লইয়া যায়। সেখানে যদি পাপের আগুন জ্বলে, তবে ঘোড়াটাকে কোনোমতে বাগ মানাইয়া ফিরাইয়া আনিবার কথা মনে আসে। এইজন্য মনুষ্যলোকে অন্যান্য সকল শিক্ষার উপরে সেই সাধনটা প্রচলিত যাহাতে ঐ আরোর ইচ্ছাটাকে বশে আনা যায়। কেননা, মানুষকে ঈশ্বর ঐ একটা ভয়ংকর বাহন দিয়াছেন, ও আমাদের কোথায় লইয়া গিয়া যে ফেলে তাহার ঠিকানা নাই। উহার মুখে লাগাম পরাও, উহাকে চালাইতে শিখ। কিন্তু তাই বলিয়া উহার দানাপানি একেবারে বন্ধ করিয়া উহাকে মারিয়া ফেলিলে চলিবে না। কেননা, এই আরো'র ইচ্ছাই মানুষের যথার্থ বাহন। প্রয়োজনসাধনের ইচ্ছা জন্তুদের বাহন। এইটে না থাকিলে তাহদের জীবনযাত্রা একেবারেই চলিত না। এই ইচ্ছাটাই প্রাকৃতিক জীবনের মূল ইচ্ছা । ইহাই দুঃখ দূর করিবার ইচ্ছা । এই ইচ্ছা যেখানে বাধা পায় সেইখানেই জন্তুদের দুঃখ, যেখানে তাহার পূরণ হয়। সেইখানেই তাহদের সুখ । তাই দেখা যায়, জন্তুদের সুখদুঃখ আছে কিন্তু পাপপুণ্য নাই । কিন্তু, মানুষের মধ্যে এই-যে আরো'র ইচ্ছা ইহা আরামের ইচ্ছা নহে, সুখের ইচ্ছা নহে, বস্তুত ইহা দুঃখেরই ইচ্ছা । মানুষ যে কেবলই প্রাণকে তুচ্ছ করিয়া আপন জ্ঞান প্রেম ও শক্তি --রাজ্যের উত্তরমেরু ও দক্ষিণমেরু আবিষ্কার করিবার জন্য বারংবার বাহির হইয়া পড়িতেছে, ইহা তাহার সুখের সাধনা নহে । ইহা তাহার কোনো বর্তমান প্রয়োজন -সাধনের ইচ্ছা নহে । বস্তুত মানুষের মধ্যে এই-যে দুই স্তরের ইচ্ছা আছে ইহার মধ্যে একটা প্রয়োজনের ইচ্ছা, আর-একটা অপ্রয়োজনের ইচ্ছা। একটা যাহা না হইলে কিছুতেই চলে না। তাহার ইচ্ছা, এবং অন্যটা যাহা না হইলে অনায়াসেই চলে তাহার ইচ্ছ। আশ্চর্য এই যে, মানুষের মনে এই দ্বিতীয় ইচ্ছাটার শক্তি এমন প্ৰবল যে, সে যখন জাগিয়া উঠে তখন সে এই প্ৰথম ইচ্ছাটাকে একেবারে ছারখার করিয়া দেয়। তখন সে সুখ-সুবিধা-প্রয়োজনের কোনো দাবিতেই একেবারে কর্ণপাত করে না। তখন সে বলে, “আমি সুখ চাহি না, আমি আরোকেই চাই, সুখ আমার সুখ নহে, আরোই আমার সুখ ।” তখন সে বলে, “ভূমৈব সুখম।” সুখ বলিতে যাহা বুঝায় তাহা ভূমা নহে। ভূমা সুখ নহে, আনন্দ । সুখের সঙ্গে আনন্দের প্রভেদ এই যে, সুখের বিপরীত দুঃখ, কিন্তু আনন্দের বিপরীত দুঃখ নহে। শিব যেমন করিয়া হলাহল পান করিয়াছিলেন, আনন্দ তেমনি করিয়া দুঃখকে অনায়াসেই গ্রহণ করে। এমন-কি, দুঃখের দ্বারাই আনন্দ আপনাকে সার্থক করে, আপনার পূর্ণতাকে উপলব্ধি করে। তাই দুঃখের তপস্যাই আনন্দের তপস্যা। তাই দেখিতেছি, অন্যান্য জন্তুদের ন্যায় মানুষের নীচের ইচ্ছাটা দুঃখনিবৃত্তির ইচ্ছা, আর উপরের ইচ্ছােটা দুঃখকে আত্মসাৎ করিয়া আনন্দলাভের ইচ্ছা। এই ইচ্ছাই কেবলই আমাদিগকে বুলিতেছে, ‘নাল্পে সুখমস্তি, ভূমীত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ ।” তাই প্রাকৃতিক ক্ষেত্রে আপনি সহজ বোধট্রিকু লইয়া জন্তু দুঃখনিবৃত্তিচেষ্টার সনাতন গণ্ডির মধ্যে বদ্ধ হইয়া বহিল। মানুষ তাহার মানসক্ষেত্রে জ্ঞান প্রেম শক্তির কোনো সীমাতেই রন্ধ হইতে চাহিল না ; সে বলিল, “অভ্যাসকে নহে, সংস্কারকে নহে, প্রথাকে নহে, আমি ভূমীকে জানিব ।” তাই যদি হয় তবে এই আরো'র ইচ্ছাকে, এই আনন্দের ইচ্ছাকে, এত করিয়া বশে আনিবার জন্য মানুষের এমন প্ৰাণপণ চেষ্টার প্রয়োজন কী ছিল । এই প্ৰকাণ্ড ইচ্ছার প্রবল স্রোতে চোখ বুজিয়া আত্মসমৰ্পণ করিলেই তো মানুষের মনুষ্যত্ব সার্থক হইত । ইচ্ছাকে বল্পবদ্ধ করিবার প্রধান কারণ এই যে, দুটা ইচ্ছার অধিকার নির্ণয় লইয়া মানুষকে বিষম সংকটে পড়তে হইয়াছে। আমাদের প্রাকৃতিক প্রয়ােজনের একটা ক্ষেত্র আছে, সেখানে আমরা সীমাবদ্ধ । সেখানে আমাদের বাসনাকে তাহার সহজ সীমার চেয়ে জোর করিয়া টানিয়া বাড়াইতে