পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পথের সঞ্চয় V66 দেন । চোখে দেখার সামগ্ৰীকে তাহার কানে শোনার জায়গায় দাড় করান, কানে শোনার সামগ্ৰীকে র্তাহারা চোখে দেখার রেখার মধ্যে রূপান্তরিত করিয়া ধরেন । এমনি করিয়া তাহারা দেখাইতেছেন জগতে রূপ জিনিসটা ধ্রুব সত্য নহে, তাহী রূপকমাত্র ; তাহার অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিলে তবেই তাহার বন্ধন হইতে মুক্তি, তবেই আনন্দের মধ্যে পরিত্রাণ । আমাদের গুণীরা ভৈরোতে টােড়িতে সুর বঁাধিয়া বলিলেন, ইহা সকালবেলাকার গান । কিন্তু, তাহার মধ্যে সকালবেলার নবজাগ্ৰত সংসারের নানাবিধ ধ্বনির কি কোনো নকল দেখিতে পাওয়া যায়। কিছুমাত্র না। তবে ভৈরোকে টােড়িকে সকালবেলার রাগিণী বলিবার কী মনে হইল। তাহার মানে এই, সকালবেলাকার সমস্ত শব্দ ও নিঃশব্দতার অন্তরতর সংগীতটিকে গুণীরা তঁহাদের অন্তঃকরণ দিয়া শুনিয়াছেন । সকালবেলাকার কোনো বহিরাঙ্গের সঙ্গে এই সংগীতকে মিলাইবার চেষ্টা করিতে গেলে সে চেষ্টা ব্যর্থ হইবে । আমাদের দেশের সংগীতের এই বিশেষত্বটি আমার কাছে বড়ো ভালো লাগে । আমাদের দেশে প্রভাত মধ্যাহ্ন। অপরাহু সায়াহ্ন। অর্ধারাত্রি ও বর্ষাবসম্ভের রাগিণী রচিত হইয়াছে। সে রাগিণীর সবগুলি সকলের কাছে ঠিক লাগিবে কি না জানি না। অন্তত আমি সারঙ রাগকে মধ্যাহ্নকালের সুর বলিয়া হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করি না । তা হউক, কিন্তু বিশ্বেশ্বরের খাসমহলের গোপন নহবতখানায় যে কালে কালে ঋতুতে ঋতুতে নব নব রাগিণী বাজিতেছে, আমাদের গুণীদের অন্তঃকৰ্ণে তাহা প্রবেশ করিয়াছে। বাহিরের প্রকাশের অন্তরালে যে-একটি গভীরতর অন্তরের প্রকাশ আছে আমাদের দেশের টোড়ি কানাড়া তাহাই জানাইতেছে। য়ুরোপের বড়ো বড়ো সংগীতরচয়িতারা নিশ্চয়ই কোনো-না-কোনো দিক দিয়া ঠাঁহাদের গানে বিশ্বের সেই অন্তরের বার্তাই প্রকাশের চেষ্টা করিয়াছেন ; তঁহাদের রচনার সঙ্গে যদি তেমন করিয়া পরিচয় হয় তবে সে সম্বন্ধে আলোচনা করা যাইবে । আপাতত য়ুরোপীয় সংগীতসভার বাহির-দেউড়িতে বাজে লোকের ভিড়ের মধ্যে যেটুকু শোনা যায় তাহার সম্বন্ধে দুই-একটা কথা আমার মনে উঠিয়াছে। আমাদের জাহাজের যাত্রীদের মধ্যে কেহ কেহ সন্ধ্যার সময় গান-বাজনা করিয়া থাকেন। যখনই সেরাপ বৈঠক বসে আমিও সেই ঘরের এক কোণে গিয়া বসি । বিলাতি গান আমার স্বভাবত ভালো লাগে বলিয়াই যে আমাকে টানিয়া আনে তাহা নহে । কিন্তু, আমি নিশ্চয় জানি, ভালো জিনিস ভালো লাগার একটা সাধনা আছে। বিনা সাধনায় যাহা আমাদিগকে মুগ্ধ করে তাহা অনেক সময়েই মোহ এবং যাহা নিরন্ত করে তাহাঁই যথার্থ উপাদেয়। সেইজন্য যুরোপীয় সংগীত আমি শুনিবার অভ্যাস করি। যখন আমার ভালো না লাগে। তখনো তাহাকে অশ্রদ্ধা করিয়া চুকাইয়া দিই না । এ জাহাজে একজন যুবক ও দুই-একজন মহিলা আছেন, তাহারা বোধ হয় মন্দ গান করেন না । দেখিতে পাই, শ্রোতারা তাহদের গানে বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করেন । যেদিন সভা বিশেষ রূপে জমিয়া উঠে সেদিন একটির পর একটি করিয়া অনেকগুলি গান চলিতে থাকে। কোনো গান বা ইংলন্ডের গৌরবগর্ব, কোনো গান বা হতাশ প্রণয়িনীর বিদায়সংগীত, কোনো গান বা প্রেমিকের প্রেমািনবেদন। সবগুলির মধ্যে একটা বিশেষত্ব আমি এই দেখি, গানের সুরে এবং গায়কের কণ্ঠে পদে পদে খুব একটা জোর দিবার চেষ্টা । সে জোর সংগীতের ভিতরকার শক্তি নহে, তাহা যেন বাহিরের দিক হইতে প্ৰয়াস। অর্থাৎ, হৃদয়াবেগের উত্থানপতনকে সুরের ও কণ্ঠস্বরের ঝোক দিয়া খুব করিয়া প্রত্যক্ষ করিয়া দিবার চেষ্টা । । ইহাই স্বাভাবিক। আমাদের হৃদয়োচ্ছিাসের সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবতই আমাদের কণ্ঠস্বরের বেগ কখনো মৃদু কখনো প্রবল হইয়া উঠে। কিন্তু, গান তো স্বভাবের নকল নহে ; কেননা, গান আর অভিনয় তো BDB DDD D DDBDBDB DD BDBDB BB DDBD D BBDB DDBDB BDB DBDB করিয়া দেওয়া হয়। তাই জাহাজের সেলুনে বসিয়া যখন ইহাদের গান শুনি তখন আমার কেবলই মনে হইতে থাকে, হৃদয়ের ভাবটাকে ইহারা যেন ঠেলা দিয়া, চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিতে চায়।