পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পথের সঞ্চয় yQ চেয়ে কষ্ঠের জোর কত বেশি। এখানে কিরূপ প্রশান্ত ভাবে এবং কিরূপ প্ৰণিধানের সঙ্গে তর্কবিতর্ক চলিতে লাগিল। মতের অনৈক্যের দ্বারা বিষয়কে বাধা না দিয়া তাহকে অগ্রসরই করিয়া দিল । অনেকে মিলিয়া কাজ করিবার অভ্যাস। ইহাদের মধ্যে কত সহজ হইয়াছে তাহা এই ক্ষণকালের মধ্যে বুঝিতে পারিলাম। ইহাদের কাজ শুরুতর, অথচ কাজের প্রণালীর মধ্যে অনাবশ্যক সংঘর্ষ ও অপব্যয় লেশমাত্র নাই। ইহাদের রথ প্ৰকাণ্ড, তাহার গতিও দ্রুত, কিন্তু তাহার ঢাকা অনায়াসে ঘোরে এবং কিছুমাত্র শব্দ করে না। বন্ধু লন্ডনে আসিয়া একটা হােটেলে আশ্ৰয় লইলাম ; মনে হইল, এখানকার লোকালয়ের দেউড়িতে আনাগোনার পথে আসিয়া বসিলাম । ভিতরে কি হইতেছে। খবর পাই না, লোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ও হয় না- কেবল দেখি, মানুষ যাইতেছে আর আসিতেছে। এইটুকুই চোখে পড়ে, মানুষের ব্যস্ততার সীমা পরিসীমা নাই ; এত অত্যন্ত বেশি দরকার কিসের তাহা আমরা বুঝিতে পারি' না। এই প্ৰচণ্ড ব্যস্ততার ধাকটা কোনখানে গিয়া লাগিতেছে, তাহাতে ক্ষতি করিতেছে কি বৃদ্ধি করিতেছে তাহার কোনো হিসাব কেহ রাখিতেছে কিনা কিছুই জানি না । ঢং ঢেং করিয়া ঘণ্টা বাজে, আহারের স্থানে গিয়া দেখি- এক-একটা ছোটো টেবিল ঘেরিয়া দুই-তিনটি করিয়া শ্ৰীপুরুষ নিঃশব্দে আহার করিতেছে ; পাঞ্জ হাতে দীর্ঘকায় পরিবেশক গভীরমুখে দ্রুতপদে ক্ষিপ্তহন্তে পরিবেশন করিয়া চলিয়াছে ; কেহ কেহ বা খাইতে খাইতেই খবরের কাগজ পড়া সারিয়া লইতেছে ; তাহার পরে ঘড়িটা খুলিয়া একবার তাকাইয়া, টুপিটা মাথায় চাপিয়া দিয়া, হন হন করিয়া চলিয়া যাইতেছে ; ঘর শূন্য হইতেছে। কেবল আহারের সময় বারকয়েক কয়েকজন মানুষ একত্র হয়, তাহার পরে কে কোথায় যায় কেহ তাহার ঠিকানা রাখে না। আমার কোনো প্রয়োজন নাই ; সকলের দেখাদেখি মিথ্যা এক-একবার ঘড়ি খুলিয়া দেখি, আবার ঘড়ি বন্ধ করিয়া পকেটে রাখি। যখন আহারেরও সময় নয়, নিদ্রারও সময় নহে, তখন হােটেল যেন ডাঙায় বাধা নীেকার মতে- তখন যদি সেখানে থাকিতে হয় তবে কেন যে আছি তাহার কোনো কৈফিয়ত ভাবিয়া পাওয়া যায় না । যাহাঁদের বাসস্থান নাই, কেবল কর্মস্থােনই আছে, তাহদেরই পক্ষে হােটেল মানায় । যাহারা আমার মতো নিতান্ত অনাবশ্যক লোক তাহদের পক্ষে বাসের আয়োজনটা এমনতরো পাইকারি রকমের হইলে পোষায় না। জানলা খুলিয়া দেখি, জনস্রোত নানা দিকে চুটিয়া চলিয়াছে। মনে মনে ভাবি, ইহারা যেন কোন এক অদৃশ্য কারিগরের হাতুড়ি । যে জিনিসটা গড়িয়া উঠিতেছে সেটাও মোটের উপর অদৃশ্য ; মন্ত একটা ইতিহাসের কারখানা ; লক্ষ লক্ষ হাতুড়ি দ্রুত প্রবল বেগে লক্ষ লক্ষ জায়গায় আসিয়া পড়িতেছে। আমি সেই এজিনের বাহিরে দাড়াইয়া চাহিয়া থাকি--- ক্ষুধার স্টমে চালিত সজীব হাতুড়িগুলা দুৰ্নিবার বেগে দুটিতেছে, ইহাই দেখিতে পাই। যাহারা বিদেশী, প্রথম এখানে আসিয়া এখানকার ইতিহাসবিধাতার এই অতিবিপুল মানুষ-কলের চেহারাটাই তাহদের চোখে পড়ে। কী দাহ, কী শব্দ, কী চাকার ঘূর্ণি। এই লন্ডন শহরের সমন্ত গতি, সমস্ত কর্মকে একবার চোখ বুজিয়া ভাবিয়া দেখিতে চেষ্টা করি।- কী ভয়ংকর অধ্যবসায়। এই অবিশ্রাম বেগ কোন লক্ষ্যের অভিমুখে আঘাত করিতেছে এবং কোন অব্যক্তকে প্রকাশের অভিমুখে घांगशा झुनिष्प्छ । কিন্তু, মানুষকে কেবল এই যন্ত্রের দিক হইতে দেখিয়া তো দিন কাটে না। যেখানে সে মানুষ সেখানে তাহার পরিচয় না পাইলেকী করিতে আসিলাম ! কিন্তু,মানুষ যেখানে কল সেখানে দৃষ্টি পড়া যত সহজ, মানুষ যেখানে মানুষ সেখানে তত সহজ নহে। ভিতরকার মানুষ আপনি আসিয়া সেখানে