পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ngŵybr রবীন্দ্র-রচনাবলী কাছে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। মানুষের জীবনের মধ্যে সুখদুঃখের যে অভিজ্ঞতা প্ৰকাশ পায় তাহাই যেন নানা অপরাপ ছদ্মবেশে ভুলোকে ও দুলোকে আপনি লীলা বিস্তার করিয়াছে। যেমন আমাদের চিত্তে তেমনি সমস্ত প্রকৃতিতে। হাসিকান্নার বেদনা, চাওয়া পাওয়া এবং হারানোর খেলা, যেমন আমাদের এই ছোটাে হৃদয়টিতে তেমনি তাঁহাই খুব প্ৰকাণ্ড করিয়া এই মহাকাশের আলোক-অন্ধকারের রঙ্গমঞ্চে । তাহা এত বৃহৎ যে তাহাকে আমরা একসঙ্গে দেখিতে পাই না বলিয়া আমরা জল দেখি, মাটি দেখি, কিন্তু সমস্তটার ভিতরকার বিপুল খেলােটাকে দেখিতে পাইনা। কিন্তু, মানুষ যখন শিক্ষা ও অভ্যাসের সৃলির ভিতর দিয়া দেখেন, যখন সে আপনার সমস্ত হৃদয় মন জীবন দিয়া দেখে, তখন সে এমন একটা বেদনার লীলাকে সব জায়গাতেই অনুভব করে যে, তাহকে গল্পের মধ্য দিয়া, রূপকের মধ্য দিয়া ছাড়া প্রকাশ করিতে পারে না। মানুষ যখন জাগতিক ব্যাপারের মধ্যে আপনারই খুব একটা বড়ো পরিচয় পাইতেছিল- এইটে একরকম করিয়া বুঝিতেছিল যে, সমস্ত জগতের মধ্যে যাহা নাই তাহা তাহার নিজের মধ্যেও নাই, যাহা তাহার মধ্যে আছে তাহাঁই বিপুল আকারে বিশ্বের মধ্যে আছে- তখনই সে কবির দৃষ্টি অর্থাৎ হৃদয়ের দৃষ্টি জীবনের দৃষ্টিতে সমস্তকে দেখিতে পাইয়াছিল ; তাহা অক্ষিগোলক ও স্নায়ুশিরা ও মস্তিষ্কের দৃষ্টি নহে। তাহার সত্যতা তথ্যগত নহে ; তাহা ভাবগত, বেদনাগত । তাহার ভাষাও সেইরূপ ; তাহা সুরের ভাষা, রূপের ভাষা। এই ভাষাই মানবসাহিত্যে সকলের চেয়ে পুরাতন ভাষা। অথচ, আজও যখন কোনো কবি বিশ্বকে আপনার বেদনা দিয়া অনুভব করেন তখন তাহার ভাষার সঙ্গে মানুষের পুরাতন ভাষার মিল পাওয়া যায়। এই কারণে বৈজ্ঞানিক যুগে মানুষের পৌরাণিক কাহিনী আর কোনো কাজে লাগে না ; কেবল কবির ব্যবহারের পক্ষে তাহা পুরাতন হইল না। মানুষের নবীন বিশ্বানুভূতি ঐ কাহিনীর পথ দিয়া আনাগোনা করিয়া ঐখানে আপন চিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে। অনুভূতির সেই নবীনতা যাহার চিত্তকে উদবোধিত করে সে ঐ পুরাতন পথটাকে স্বভাবতই ব্যবহার করিতে প্ৰবৃত্ত হয়। কবি য়েটস আয়ার্লন্ডের সেই পৌরাণিক পথ দিয়া নিজের কাব্যধারাকে প্রবাহিত করিয়াছেন । ইহা র্তাহার পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হইয়াছিল বলিয়াই এই পথে তিনি এমন অসামান্য খ্যাতি উপার্জন করিতে পারিয়াছেন । তিনি তাহার জীবনের দ্বারা এই জগৎকে স্পর্শ করিতেছেন ; চোখের দ্বারা জ্ঞানের দ্বারা নহে। এইজন্য জগৎকে তিনি কেবল বস্তুজগৎ রাপে দেখেন না ; ইহার পর্বতে প্ৰান্তরে ইনি এমন একটি লীলাময় সত্তাকে অনুভব করেন যাহা ধ্যানের দ্বারাই গম্য। আধুনিক সাহিত্যে অভ্যন্ত প্ৰণালীর মধ্য দিয়া তাহাকে প্রকাশ করিতে গেলে তাহার রস ও প্ৰাণ নষ্ট হইয়া যায় ; কারণ, আধুনিকতা জিনিসটা আসলে নবীন নহে, তাহা জীৰ্ণ ; সর্বদা ব্যবহারে তাহাতে কড়া পড়িয়া গেছে, সর্বত্র তাহা সাড়া দেয় না ; তাহা ছাই-চাপা আগুনের মতো । এই আগুন জিনিসটা ছাইয়ের চেয়ে পুরাতন অথচ তাহা নবীন ; ছাইটা আধুনিক বটে। কিন্তু তাহাঁই জরা। এইজন্য সর্বত্রই দেখিতে পাই, কাব্য আধুনিক ভাষাকে পাশ কাটাইয়া চলিতে চায়। সকলেই জানেন, কিছুকাল হইতে আয়ার্লন্ডে একটা স্বদেশিকতার বেদনা জাগিয়া উঠিয়াছে । ইংলন্ডের শাসন সকল দিক হইতেই আয়ার্লন্ডের চিত্তকে অত্যন্ত চাপা দিয়াছিল বলিয়াই এই বেদনা এক সময়ে এমন প্রবল হইয়া উঠিয়ছিল । অনেকদিন হইতে এই বেদনা প্ৰধানত পোলিটিকাল বিদ্রোহ-রূপেই আপনাকে প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিয়াছে। অবশেষে তাহার সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা চেষ্টা দেখা দিল। আয়ার্লভূ আপনার চিত্তের স্বাতন্ত্র্য উপলব্ধি করিয়া তাঁহাই প্ৰকাশ করিতে উদ্যত इन्छ । এই উপলক্ষে আমাদের নিজের দেশের কথা মনে পড়ে। আমাদের দেশেও অনেকদিন হইতে পোলিটিকাল অধিকার-লাভের একটা চেষ্টা শিক্ষিতমণ্ডলীর মধ্যে প্রবল হইয়া উঠিয়ছিল। দেখা গিয়াছে, এই চেষ্টার ব্যাহার নেতা ছিলেন তাহদের অনেকেরই দেশের ভাষা সাহিত্য-আচারব্যবহারের সহিত সংস্রব ছিল না । দেশের জনসাধারণের সঙ্গে ঠাহীদের যোগ ছিল না বলিলেই হয় । দেশের উন্নতিসাধনের জন্য ঠাঁহাদের যাহা কিছু কারবার সমস্তই ইংরেজি ভাষায় ও ইংরেজি গবর্মেন্টের