পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

t ब्री-कानांची ইংলন্ডের ভাবুকসমাজ বাহিরের ভিড়ের মধ্য হইতে আমি যেন অন্তরের ভিড়ের ভিতরে গিয়া প্রবেশ করিলাম, এইরূপ আমার মনে হইল। এ দেশের ধােহারা লেখক, ধ্যাহারা চিন্তাশীল, তাহদের সংস্রবে। যতই আসিলাম ততই অনুভব করিতে লাগিলাম, ইহাদের চিন্তার পথে ভাবের ঠেলা ঠেলি অত্যন্ত প্ৰবল। ইহাদের সমাজ সকলের শক্তিকে যে পূর্ণবেগে আকর্ষণ করিতেছে, বাহিরে লোকের চুটীচুটি, মোটরযানের হুড়াছড়িতে তাহা স্পষ্টই চোখে পড়ে। কাহারও সময় নাই ; তাড়াতাড়ি কাজ সারিতে হইবে ; এ সমাজ কাহাকেও পিছাইয়া পড়িয়া থাকিতে দিবে না ; যে একটু পিছাইয়া পড়িবে তাহাকেই হারমানিতে হইবে। এই সম্মুখে চুটিবার ভয়ংকর ব্যগ্ৰতা যখন দেখি তখন মনে মনে ভাবি, সম্মুখে সে কে বসিয়া আছে। সে ডাক দেয়। কিন্তু দেখা দেয় না। নীল সমুত্রের মতো বহুদূরে তাহার ঢেউয়ের উপর ঢেউ নিশিদিন হাত তুলিতেছে, কিন্তু কোথায় কোন পর্বতশিখরের গুহাগহবর হইতে ঝরনাগুলি পাগলের মতো ব্যন্ত হইয়া, ডাহিনে ৰীয়ে নুড়ি পাথরগুলাকে কোনোমতে ঠেলিয়া ঠুলিয়া, কাহাকেও কোনো ঠিকানা জিজ্ঞাসা না করিয়া, উর্ধ্বশ্বাসে দুটিয়া চলিয়াছে। বাহিরের কাজের ক্ষেত্রে এই যেমন ইকাইকি দৌড়াদৌড়ি, চিন্তার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনিই। কত হাজার হাজার লোক যে উৰ্ব্বশ্বাসে চিন্তা করিয়া চলিয়াছে তাহার ঠিকানা নাই । দৈনিক কাগজে, অবিশ্রাম বহিয়া চলিয়াছে। মানসিক শক্তি যাহার যে রকমের এবং যে পরিমাণে আছে তাহার সমস্তািটার উপর টান পড়িয়ছে। চাই আরো চাই, দেশের মর্মস্থান হইতে এই একটা ডাক সর্বদা সর্বত্র পৌঁছিতেছে। এত বড়ো একটা ডাকে কাহারও সবুর সহে না, ক্ষণকালচুপ করিয়া থাকিতে হইলে মন উতলা হইয়া উঠে। দেশের এই মানসভাণ্ডারে যে লোক একবার একটা কিছু জোগাইয়াছে তাহার আর নিকৃতি নাই ; সে লোকের উপর আরোর তাগিদ পড়িল ; খেজুরগাছের মতো বৎসরের পর বৎসরে কাটের পর কাট চলিতে থাকে ; কোনো বারে রসের একটু কমতি বা বিরাম পড়িলে সে পাড়াসুদ্ধ লোকের প্রশ্নের বিষয় হইয়া উঠে । কাজেই এখানকার মনোরাজ্যটা যদি চোখে দেখিবায় হইত। তবে দেখিতাম, সদর রান্তায় এবং গলিতে, আপিস-পাড়ায় এবং বারোয়ারি-তলায় হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেছে ; ভিড় ঠেলিয়া চলা দায়। সেখানেও কেহ বা পায়ে হঁটিয়া চলে, কেহ বা মোটরগাড়ি ইকোয় ; কেহ বা মজুরি করে, কেহ বা মাৰি দিয়া খালে সিদ্ধসকেলা নিবন্ধ। কােবেলাওঁতে স্নাতকৃষ্ণ পর্ব চলাচলেজ কথাটা নূতন নহে। আমাদের দেশের তন্ত্রালস নিস্তািন্ধ মধ্যাহ্নেও আমরা অর্ধেক চোখ বুজিয়া আন্দাজ করিতে পারি, এ দেশের চিন্তার হাটে কী ভয়ংকর কোলাহল এবং ঠেলা ঠেলি । কিন্তু, সেই ভিড়ের চাপটা নিজের মনের উপর যখন ঠেলা দেয় তখন স্পষ্ট করিয়া বুঝিতে পারি তাহার বেগ কতখানি। এ দেশে ধ্যাহারা মনের কারবার করেন। তঁহাদের কাছে আসিলে সেই বেগটা বুঝিতে বিলম্ব ३ नीं । ইহাদের সঙ্গে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনেরও নয়, খুব অন্তরঙ্গও নয়, ক্ষণকালের দেখাসাক্ষাৎ মাত্র। কিন্তু, সেই সময়টুকুর মধ্যে একটা জিনিস লক্ষ্য করিয়া আমি বারংবার বিন্মিত হইয়াছি, সেটা ইহাদের মনের ক্ষিপ্তহত্ততা । মন ইলেকট্রিক আলোর তারের মতো সর্বদা যেন প্ৰস্তুত হইয়াই আছে, বোতামটি টিপিবামাত্র তখনই জ্বলিয়া উঠে। আমাদের প্রদীপের আলোর ব্যবহার ; সলিত পকাইয়l, তেল ঢালিয়া, চকমকি ?কিয়া কাজ চালাইয়া থাকি-বিশেষ কোনো তাগিদ নাই, সুতরাং দেরি হইলোঁ কিছুই আসে যায় না। অতএব, আমাদের যেরূপ অভ্যাস তাহাতে আমার পক্ষে এই ইলেকট্রিক আলোর ক্ষিপ্ৰতা সম্পূর্ণ নূতন।