পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পথের সঞ্চয় ©brዒ থাকিবে। পাছে যুরোপের সংসর্গে আমরা আপনাকে বিস্মৃত হই এই ভয়ের কথাই আমরা শুনিয়া আসিতেছি ; কিন্তু তাহা সত্য নহে, তাহার উলটা কথাই সত্য। এই প্রবল সজীব শক্তির প্রথম সংঘাতে কিছুকালের জন্য আমরা দিশা হারাইয়া থাকি, কিন্তু শেষকালে আমরা নিজের প্রকৃতিকেই জাগ্রততর করিয়া পাই। য়ুরোপের প্রাণবান সাহিত্য আমাদের সাহিত্যের প্রয়াসকে জাগাইয়াছে ; তাহা যতই বলবান হইয়া উঠিতেছে ততই অনুকরণের হাত এড়াইয়া আমাদিগকে আত্মপ্রকাশের পথে অগ্রসর করিয়া দিতেছে। আমাদের শিল্পকলায় সম্প্রতি যে উদবোধন দেখা যাইতেছে তাহার মূলেও যুরোপের প্রাণশক্তির আঘাত রহিয়াছে। আমার বিশ্বাস, সংগীতেও আমাদের সেই বাহিরের সংশ্ৰব প্রয়োজন হইয়াছে ; তাহাকে প্রাচীন দত্তরের লোহার সিন্ধুক হইতে মুক্ত করিয়া বিশ্বের হাটে ভাঙাইতে হইবে। য়ুরোপীয় সংগীতের সঙ্গে ভালো করিয়া পরিচয় হইলে তবেই আমাদের সংগীতকে আমরা সত্য করিয়া, বড়ো করিয়া, ব্যবহার করিতে শিখিব। দুঃখের বিষয়, সংগীত আমাদের শিক্ষিত লোকের শিক্ষার অঙ্গ নহে ; আমাদের কলেজ-নামক কেরানিগিরির কারখানাঘরে শিল্পসংগীতের কোনো স্থান নাই, এবং আশ্চর্যের কথা এই যে, যে-সকল বিদ্যালয়কে আমরা ন্যাশনাল নাম দিয়া স্থাপন করিয়াছি সেখানেও কলাবিদ্যার কোনো আসন পীত হইল না। মানুষের সামাজিক জীবনে ইহার প্রয়োজন যে কত বড়ো, নেট মুখস্থ করিতে করিতে, ডিগ্রি নিতে নিতে, সেই বোধট্রিকু পর্যন্ত আমরা সম্পূৰ্ণহারাইয়া বসিয়াছি। এইজন্য সংগীত আজ পর্যন্ত সেই সকল অশিক্ষিত লোকের মধ্যেই বন্ধ যাহাদের সম্মুখে বিশ্বের প্রকাশ নাই, যাহারা অক্ষম স্ত্রীলোকের মতো নিজের সমস্ত ধনকে গহনা গড়াইয়া রাখিয়াছে, তাহাকে কেবল বহন করিতেই পারে, সর্বতোভাবে ব্যবহার করিতে পারে না ; এমন-কি, ব্যবহারের কথার আভাস দিলেই তাহারা আতঙ্কিত হইয়া উঠে- মনে করে, ইহা তাহদের সর্বস্ব খোওয়াইবার পন্থা । অতএব, আমাদের ধন যখন আমরা ভালো করিয়া ব্যবহার করিতে পারিলাম না । তখন যাহারা পারে তাহারা একদিন ইহাকে নিজের ব্যবসায়ে খাটাইবে, ইহাকে বিশ্বের কাজে লাগাইবার পথে আনিবে । আমাদিগকে সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিতে হইবে, তাহার পরে গর্ব করিব, আমাদের যাহা আছে জগতে এমন আর কাহারও নাই ; সেই গর্ব করিবার উপকরণও অন্য লোককে জোগাইয়া দিতে হইবে । ୪୩୪୩୪୦୯୭୩ আমরা যখন বিলাতে যাত্রা করি তখন সেটা কেবল দেশ হইতে দেশান্তরে যাওয়া নয়, আমাদের পক্ষে সেটা একটা নূতন সংসারে প্রবেশ করা। জীবনযাত্রার বাহ্য প্রভেদগুলাতে বড়ো-একটা-কিছু আসে-যায় না। আমাদের সঙ্গে বসনে-ভুষণে আহারে বিহারে বিদেশীর সাদৃশ্য থাকিবে না, সেটা তো ধরা কথা, সুতরাং সেখানে বিশেষ বাধে না। কিন্তু, কেবল জীবনযাত্রার নহে, জীবনতত্ত্বে একটা মােসর গভীরতর অলি আছে সেখােন নিৰ্ম্মি ফর ফাং আমােদর পক্ষে ফাঁদ জাহাজে উঠিয়াই আমরা প্রথম সেটা অনুভব করিতে শুরু করি। বুঝিতে পারি, এখন হইতে আমাদিগকে আর-ক সংসারের নিয়মে চলিতে হইবে । হঠাৎ এতখানি পরিবর্তন মানুষের পক্ষে অপ্রিয়- এইজন্যই আমরা সেটাকে ভালো করিয়া বুঝিয়া দেখিবার চেষ্টা করি না, কোনোমতে মানিয়া চলি কিংবা মনে মনে বিরক্ত হইয়া বলি, ইহাদের চাল-চলনটা অত্যন্ত বেশি কৃত্ৰিম । আসল কথা, ইহাঙ্গের সঙ্গে আমাদের সামাজিক অবস্থার যে প্রভেদ আছে সেইটেই গুরুতর। পরিবার এবং পানীমণ্ডলীর সীমায় আসিয়া আমাদের সমাজ থামিয়াছে। সেই সীমার মধ্যেই পরস্পরের