পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO রবীন্দ্র-রচনাবলী তামাক খাইতে থাকা চলে না। ঘাড়ের উপর কাজ আসিয়া পড়ে, নূতন নূতন চেষ্টা করিতেই হয়, এবং বাহিরের জীবনস্রোতের সঙ্গে নিজের জীবনযাত্রাকে বানাইতে না পারিলে খাওয়া-দাওয়া কাজকর্ম সমন্তেরই ব্যাঘাত ঘটিতে থাকে । কিছুকালের জন্য ভারতবর্ষ অত্যন্ত বাধা নিয়মের নিশ্চল ব্যবস্থার মধ্যে স্বচ্ছদে রাত্রিযাপন করিয়াছে। সেই অবস্থােটা গভীর আরামের বলিয়াই সেটা যে চিরকালই আরামের হইবে তাহা নহে। আঘাত সবচেয়ে কঠিন বেদনাজনক যখন তাহা ঘুমন্ত শরীরের উপর আসিয়া পড়ে। দিনের বেলা সেই আঘাতের সময় । এইজন্য দিনে জাগিয়া থাকাই সবচেয়ে আরামের । ইচ্ছা করি আর-না করি, সর্বাঙ্গে আলস্য জড়াইয়া থােক। আর না-থাক, আমাদের জাগিাবার সময় আসিয়াছে। আমরা সমাজের ভিতর হইতে ও বাহির হইতে আঘাত পাইতেছি, দুঃখ পাইতেছি। আমরা দৈন্যে দুর্ভিক্ষে পীড়িত। সমাজব্যবস্থায় ভাঙন ধরিয়াছে ; একান্নাবতী পরিবার খণ্ড খণ্ড হইয়া পড়িতেছে ; এবং সমাজে ব্ৰাহ্মণের পদ ক্রমশই এমন খাটো হইয়া আসিতেছে যে, ‘ব্রাহ্মণসমাজ প্রভৃতি সভা সমিতির সাহায্যে ব্ৰাহ্মণ চীৎকারশব্দে আপনাকে ঘোষণা করিয়া আপনার দুর্বলতা সপ্রমাণ করিয়া তুলিতেছে। পল্লীসমাজের পঞ্চায়েত-প্ৰথা। গবর্মেন্টের চাপরাশ গলায় বাধিয়া আত্মহত্যা করিয়া ভূত হইয়া পল্লীর বুকে চাপিতেছে; দেশের অন্নে টােলের আর পেট ভরিতেছে না, দুর্ভিক্ষের দায়ে একে একে তাহারা সরকারি অন্নসত্রের শরণাপন্ন হইতেছে ; দেশের ধনী-মানীরা জন্মস্থানের বাতি নিবাইয়া দিয়া কলিকাতায় মোটরগাড়ি চড়িয়া ফিরিতেছে ; এবং বড়ো বড়ো কুলশীল আপনার যথাসর্বস্ব এবং কন্যাটিকে লইয়া বি. এ. পাস-করা বরের পায়ে বৃথা মাথা খুঁড়িয়া মরিতেছে। এই সমস্ত দুর্লক্ষণের জন্য কলিযুগকে বিদেশী রাজাকে বা স্বদেশী ইংরেজিনবিশকে গালি দিয়া কোনো ফল নাই। আসল কথা, আমাদের দিনের বেলাকার প্রভু তাহার চাপরাশি পঠাইয়াছেন ; আমাদের সনাতন শয়নাগার হইতে সে আমাদিগকে টানিয়া বাহির না করিয়া ছাড়িবে না । জোর করিয়া চোখ বুজিয়া আমরা অকালে রাত্রি সৃজন করিতে পারিব না। যে পৃথিবী আমাদের দ্বারে আসিয়া পৌঁছিয়াছে তাহাকে আমাদের ঘরে আহবান করিয়া আনিতেই হইবে। যদি আদর করিয়া তাহাকে না আনি তবে সে আমাদের দ্বারা ভাঙিয়া প্ৰবেশ করিবে । দ্বার কি এখনই ভাঙে নাই । অতএব, আবার একবার আমাদিগকে নূতন করিয়া সমস্যাসমাধানের জন্য ভাবিতে হইবে। যুরোপের করিয়া সে কাজ চলিবে না ; কিন্তু, য়ুরোপের কাছ হইতে শিক্ষা করিতে হইবে । শিক্ষা করা এবং নকল করা একই কথা নহে। বস্তুত, ঠিকভাবে শিক্ষা করিলেই নকল করার ব্যাধি হইতে পরিত্রাণ পাওয়া যায় । অন্যকে সত্যরূপে না জানিলে নিজেকে কখনোই সত্যরূপে জানা যায় না। কিন্তু, যাহা বলিতেছিলাম। সে কথাটা এই যে, আমাদের ঘোরো চিলাঢ়ালা অভ্যাস লইয়া যুরোপীয় সমাজে আমাদের অত্যন্ত বাধে । কোনোমতেই প্ৰস্তুত হইয়া উঠিতে পারি না । মনে হয়, সকলেই আমাকে ঠেলিয়া চলিয়া যাইতেছে, কেহ আমার জন্য কিছুমাত্র অপেক্ষা করিতেছে না। আমরা আদর-আবদারের জীব, আত্মীয়সমাজের বাহিরে আমাদের বড়ো বিপত্তি । আমি এখানে আসিয়া ইহা লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম, আমাদের ঘরের ছেলের পরের বাড়িতে প্রবেশের অভ্যাস নাই বলিয়াই আমাদের অধিকাংশ ছাত্র এখানে আসিয়া পড়া মুখস্থ করে, কিন্তু এখানকার সমাজের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না। এখানকার সমাজে বড়ো বলিয়াই এখানকার সমাজের দায় বেশি। সেই দায় স্বীকার করিলে তবে এখানকার লোকের সঙ্গে সমাজের ক্ষেত্রে আমাদের মিল হইতে পারে। সেই মিল না। ঘটিলে এখানকার সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা হইতে আমরা বঞ্চিত হইব । কারণ, এখানকার সবচেয়ে বড়ো সত্য এখানকার সমাজ । বস্তুত, এখানকার সবচেয়ে বড়ো বীরত্ব বড়ো মহন্তু এখানকার সমাজের ক্ষেত্রে, যুদ্ধক্ষেত্রে নহে। প্রশান্ত সমাজের উপযোগী ত্যাগ এবং আত্মসন্মান এখানে পদে পদে প্রকাশ পাইতেছে ; এইখানে ইহারা মানুষ হইতেছে এবং নানা পথে মানুষের কাজে আপনাকে দান করিবার জন্য ইহারা প্ৰস্তুত হইয়া উঠিতেছে। আধুনিক ভারতবর্ধের শিক্ষিত ভদ্রসম্প্রদায় নিজের দেশেও স্কুলের শিক্ষাকেই শিক্ষা বলিয়া গণ্য করে- বৃহৎ সমাজের শিক্ষা হইতে বঞ্চিত ; এখানেও আসিয়া