পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VSV রবীন্দ্র-রচনাবলী করিয়া মানুষ করা যায় না। এক দল বলিতেছে, চোখে-কনে ভাবে-আভাসে শিক্ষার বিষয়গুলিকে প্রকৃতির মধ্যে শোষণ করিয়া লইবার ব্যবস্থাই উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা ; আর-এক দল বলিতেছে, সচেষ্টভাবে নিজের শক্তিকে প্রয়োগ করিয়া সাধনার দ্বারা বিষয়গুলিকে আয়ত্ত করিয়ালওয়াই যথার্থ ফলদায়ক। বস্তুত এ দ্বন্ধ কোনোদিনই মিটবে না- কেননা, মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই এ দ্বন্ধ সত্য; সুখও তাহাকে শিক্ষা দেয়, দুঃখও তাঁহাকে শিক্ষা দেয় ; শাসন নাহিলেও তাহার চলে না, স্বাধীনতা নাহিলেও তাহার রক্ষা নাই ; এক দিকে তাহার পড়িয়া-পাওয়া জিনিসের প্রবেশদ্বার খোলা, আর-এক দিকে তাহার খাটিয়া-আনা জিনিসের আনাগোনার পথ উন্মুক্ত । এ কথা বলা সহজ যে, দুইয়ের মাঝখানের পথটিকে পাকা করিয়া চিহ্নিত করিয়া লাও ; কিন্তু কাৰ্যত তাহা অসাধ্য। কারণ জীবনের গতি কোনোদিনই একেবারে সোজা রেখায় চলে না- অন্তর বাহিরের নানা বাধায় ও নানা তাগিদে সে নদীর মতো আঁকিয়া-বাকিয়া চলে, কাটা খালের মতো সিধা পড়িয়া থাকে না ; অতএব, তাহার মাঝখানের রেখাটি সোজা রেখা নহে, তাহাকেও কেবলই স্থানপরিবর্তন করিতে হয়। এখন তাহার পক্ষে যাহা মধ্যরেখা আর-একসময় তাহাঁই তাহার পক্ষে চরম প্ৰান্তরেখা ; এক জাতির পক্ষে যাহা প্রান্তপথ আর-এক জাতির পক্ষে তাহাই মধ্যপথ । নানা অনিবাৰ্য কারণে মানুষের ইতিহাসে কখনো যুদ্ধ আসে, কখনো শান্তি আসে ; কখনো ধনসম্পদের জোয়ার আসে, কখনো তাহার ভাটার দিন উপস্থিত হয় ; কখনো নিজের শক্তিতে সে উন্মুক্ত হইয়া উঠে, কখনো নিজের অক্ষমতাবোধে সে অভিভূত হইয়া পড়ে। এমন অবস্থায় মানুষ যখন এক দিকে হেলিয়া পড়িতেছে তখন আর-এক দিকে প্রবল টান দেওয়াই তাহার পক্ষে সৎশিক্ষা । মানুষের প্রকৃতি যখন সবলভাবে সজীব থাকে তখন আপনার ভিতর হইতেই একটা সহজ শক্তিতে আপনার ভারসামঞ্জস্যের পথ সে বাছিয়া লয়। যে মানুষের নিজের শরীরের উপর দখল আছে সে যখন এক দিক হইতে ধাক্কা খায় তখন সে স্বভাবতই অন্য দিকে ভর দিয়া আপনাকে সামলাইয়া লয় ; কিন্তু, মাতাল একটু ঠেলা খাইলেই কাতি হইয়া পড়ে এবং সে অবস্থাতেই পড়িয়া থাকে। যুরোপের ছেলেদের মানুষ করিবার পন্থা আপনা-আপনি পরিবর্তিত হইতেছে । ইহাদের চিত্ত ঘতই নানা ভাবের জ্ঞানের অভিজ্ঞতার সংস্রবে। সচেতন হইয়া উঠিতেছে ততই ইহাদের পথের পরিবর্তন দ্রুত হইতেছে। অতএব, চিত্তের গতি-অনুসারেই শিক্ষার পথ নির্দেশ করিতে হয়। কিন্তু, যেহেতু গতি বিচিত্র এবং তাহাকে সকলে স্পষ্ট করিয়া চোখে দেখিতে পায় না, এইজন্যই কোনোদিনই কোনো একজন বা একদল লোক এই পথ দৃঢ় করিয়া নির্দিষ্ট করিয়া দিতে পারে না । নানা লোকের নানা চেষ্টার সমবায়ে আপনিই সহজ পথটি অঙ্কিত হইতে থাকে । এইজন্য সকল জাতির পক্ষেই আপনি পরীক্ষার পথ খোলা রাখাই সত্যপথ-আবিষ্কারের একমাত্র পন্থা । কিন্তু, যে দেশে সামাজিক শিক্ষাশালায় বাধা প্রথা হইতে এক-ঢুল সরিয়া গেলে জাত হারাইতে হয় সে দেশে মানুষ হইবার পক্ষে গোড়াতেই একটা প্ৰকাণ্ড বাধা । সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিতেছেই এবং ঘটিবেই, কেহ তাহাকে ঠেকাইয়া রাখিতে পরিবে না- অথচ ব্যবস্থাকে সনাতন রেখায় পাকা করিয়া রাখিলে মানুষের পক্ষে তেমন দুৰ্গতির কারণ আর-কিছুই হইতে পারে না। এ কেমনতরো । যেমন, নদী সরিয়া যাইতেছে কিন্তু বাধা ঘাট একই জায়গায় পড়িয়া আছে, খেয়ানীেকার পথ একই জায়গায় নির্দিষ্ট ; সে ঘাট ছাড়া অন্য ঘাটে নামিলে ধোবা নাপিত বন্ধ। সুতরাং ঘাট আছে কিন্তু জল পাই না, নীেকা আছে কিন্তু তাহার চলা বন্ধ । এমন অবস্থায় আমাদের সমাজ আমাদের কালের উপযোগী শিক্ষা আমাদিগকে দিতেছে না ; আমাদিগকে দুই-চারি হাজার বৎসর পূর্বকালের শিক্ষা দিতেছে। অতএব মানুষ করিয়া তুলিবার পক্ষে সকলের চেয়ে যে বড়ো বিদ্যালয় সেটা আমাদের বন্ধ। আমাদের বর্তমান কালের দিকে তাকাইয়া আমাদের জীবনযাত্রার প্রতি তাহার কোনো দাবি নাই। একদিন আমাদের ইতিহাসের একটা বিশেষ অবস্থায় আমাদের সমাজ মানুষের কাহাকেও ব্রাহ্মণ, কাহাকেও ক্ষত্রিয়, কাহাকেও বৈশ্য বা শূদ্র হইতে বলিয়ছিল। আমাদের প্রতি তাহার এই একটা কালোপযোগী দাবি ছিল, সুতরাং এই দাবির প্রতি লক্ষ