পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছেলেবেলা আমি জন্ম নিয়েছিলুম। সেকেলে কলকাতায় । শহরে শ্যাকরাগাড়ি ছুটছে তখন ছড়াছড়া করে ধুলো উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হাড়-বের করা ঘোড়ার পিঠে । না ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মোটরগাড়ি। তখন কাজের এত বেশি ইসফাসানি ছিল না, রয়ে বসে দিন চলত। বাবুরা আপিসে যেতেন। কযে তামাক টেনে নিয়ে পানচিবতে চিবতে, কেউ বা পালকি চড়ে কেউ বা ভাগের গাড়িতে। যারা ছিলে টাকাওয়ালা তাদের গাড়ি ছিল তকমা-আঁকা, চামড়ার আধিঘোমটাওয়ালা ; কোচাবাক্সে কোচমান বসত মাথায় পাগডি হেলিয়ে, দুই দুই সইস থাকত। পিছনে, কোমরে চামর বাধা, হেঁইয়ো শব্দে চমক লাগিয়ে দিত পায়ে-চলতি মানুষকে । মেয়েদের বাইরে যাওয়া-আসা ছিল দরজাবন্ধ পালকির ইপি-ধরানো অন্ধকারে, গাড়ি চড়তে ছিল ভারি লজ্জা । রোদবৃষ্টিতে মাথায় ছাতা উঠত না । কোনো মেয়ের গায়ে সেমিজ পায়ে জুতো দেখলে সেটাকে বলত মেমসাহেবি ; তান মানে, লজ্জাশরমের মাথা খাওয়া। কোনো মেয়ে যদি হঠাৎ পড়ত। পরপুরুষের সামনে, ফস করে তার ঘোমটা নামত নাকের ডগা পেরিয়ে, জিভ কেটে চট্ট করে দাড়াত সে পিঠ ফিরিয়ে । ঘরে যেমন তাদের দরজা বন্ধ, তেমনি বাইরে বেরবার পালকিতেও ; বড়োমানুষের ঝি-বাউদের পালকির উপরে আরো একটা ঢাকা চাপা থাকত মোটা ঘটাটোপের । দেখতে হত যেন চলতি গোরস্থান । পাশে পাশে চলত পিতলে-বাঁধানাে লাঠি হাতে দারোয়ানজি। ওদের কাজ ছিল দেউড়িতে বসে বাড়ি আগলানাে, দাড়ি চোমরানো, ব্যাঙ্কে টাকা আর কুটুমবাড়িতে মেয়েদের পৌঁছিয়ে দেওয়া, আর পার্বণের দিনে গিন্নিকে বন্ধ পালকি-সূদ্ধ গঙ্গায় ডুবিয়ে আনা । দরজায় ফেরিওয়ালা আসত বাক্স সাজিয়ে, তাতে শিউনন্দনেরও কিছু মুনফগ থাকত। আর ছিল ভাড়াটে গাড়ির গাড়োয়ান, বাখরা নিয়ে বনিয়ে থাকতে যে নারাজ হত সে দেউড়ির সামনে বধিয়ে দিত বিষম ঝগড়া । আমাদের পালোয়ান জমাদার সোভারাম থেকে থেকে বাও কষত, মুগুর ভাজত মন্ত ওজনের, বসে বসে সিদ্ধি যুঁটত, কখনো বা কঁচা শাক-সূদ্ধ মুলো য়েত আরামে আর আমরা তার কানের কাছে চীৎকার করে উঠতৃম “রাধাকৃষ্ণ' '; সে যতই ই-ই করে দু হাত তুলত আমাদের জেদী ততই বেড়ে উঠত । ইষ্টদেবতার নাম শোনবার জন্যে ঐ ছিল তার ফন্দি । তখন শহরে না ছিল গ্যাস, না ছিল বিজলি বাতি ; কেরোসিনের আলো পরে যখন এল তার তেজ দেখে আমরা অবাক । সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ঘরে ফরাস এসে জ্বালিয়ে যেত রেড়ির তেলের আলো । আমাদের পড়বার ঘরে জ্বলিত দুই সালতের একটা সেজ । মাস্টারমশায়’ মিটমিটে আলোয় পড়াতেন প্যারী সরকারের ফাস্ট বুক । প্ৰথমে উঠত হই, তার পর আসত ঘুম, তার পর চলত চোখ-রগড়নি। বারবার শুনতে হত, মাস্টারমশায়ের অন্য ছাত্র সতীন সোনার টুকরো ছেলে, পড়ায় আশ্চৰ্য মন, ঘুম পেলে চোখে নাস্যি ঘষে। আর আমি ? সে কথা বলে কােজ নেই। সব ছেলের মধ্যে একলা মুল্লখু হয়ে থাকবার মতো বিশ্ৰী ভাবনাতেও আমাকে চেতিয়ে রাখতে পারত না। রাত্ৰি নটা বাজলে ঘুমের ঘোরে ঢুলু ঢুলু চোখে দুটি পেতুম । বাহিরমহল থেকে • বাড়ির ভিতর যাবার সরু পথ ছিল খড়খাঁড়ির আব্ৰু-দেওয়া, উপর থেকে কুলত মিটমিটে আলোর ১ “মাস্টার অঘোরবাবু?— জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্র-রচনাবলী, সপ্তদশ খণ্ড, পূ: ২৮৬(সুলভ নবম খণ্ড,পূ৪২৫)