পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছেলেবেলা ANO ফরমাশ খাটত সে আসছে খাতাঞ্চিখানায় কানে-পালখের-কলম-গোজা কৈলাস মুখুজের কাছে পাওনার দাবি জানাতে ; উঠোনে বসে টং টং আওয়াজে পুরোনো লেপের তুলে ধুনছে ধুনুরি। বাইরে কানা পালোয়ানের সঙ্গে মুকুন্দলাল দারোয়ান লুটােপুটি করতে করতে কুস্তির প্যাচ কষছে। চটচটি শব্দে দুই পায়ে লাগাচ্ছে চাপড়, ডন ফেলছে বিশ-পঁচিশ বার ঘন ঘন । ভিখিরির দল বসে আছে বরাদ ভিক্ষার আশা করে । দিনটা ঘণ্টার হিসাব মানে না । সেখানকার বারোটা সেই সাবেক কালের, যখন রাজবাড়ির সিংহদ্বারে সভাভঙ্গের ডঙ্কা বাজত, রাজা যেতেন স্নানে, চন্দনের জলে। ছুটির দিন দুপুরবেলা যাদের তাবেদারিতে ছিলুম তারা খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুম দিচ্ছে। একলা বসে আছি। চলেছে মনের মধ্যে আমার অচল পালকি, হাওয়ায় তৈরি বেহারিাগুলো আমার মনের নিমক খেয়ে মানুষ। চলার পথটা কাটা হয়েছে আমারই খেয়ালে। সেই পথে চলছে পালকি দূরে দূরে দেশে দেশে, সে-সব দেশের বইপড়া নাম আমারই লাগিয়ে দেওয়া । কখনো বা তার পথটা ঢুকে পড়ে ঘন বনের ভিতর দিয়ে। বাঘের চোখ জ্বলজ্বল করছে, গা করছে ছমছম। সঙ্গে আছে বিশ্বনাথ শিকারী, বন্দুক দুটিল দুম, ব্যাস সব চুপ। তার পরে এক সময়ে পালকির চেহারা বদলে গিয়ে হয়ে ওঠে ময়ূরপখি, ভেসে চলে সমুদ্রে, ডাঙা যায় না দেখা । দাড় পড়তে থাকে ছপছপ ছপছপ, ঢেউ উঠতে থাকে দুলে দুলে ফুলে ফুলে। মাল্লারা বলে ওঠে, সামাল সামাল, ঝড় উঠল। হালের কাছে আবদুল মাঝি, ছুঁচালো তার দাড়ি, গোফ তার কমানো, মাথা তার নেড়া। তাকে চিনি, সে দাদাকে এনে দিত পদ্মা থেকে ইলিশ মাছ আর কচ্ছপের ডিম । সে আমার কাছে গল্প করেছিল- একদিন চত্তির মাসের শেষে ডিঙিতে মাছ ধরতে গিয়েছে, হঠাৎ এল কালবৈশাখী । ভীষণ তুফান, নীেকো ডোবে ডোবে। আবদুল দাতে রশি কামড়ে ধরে বঁাপিয়ে পড়ল জলে, সীতরে উঠল চরে, কাছি ধরে টেনে তুলল তার ডিঙি। গল্পটা এত শিগগির শেষ হল, আমার পছন্দ হল না । নীেকোটা ডুবল না, অমনিই বেঁচে গেল, এ তো গপপই নয়। বার বার বলতে লাগলুম ‘তার পর ? * সে বললে, “তার পর সে এক কাণ্ড । দেখি, এক নেকড়ে বাঘ। ইয়া তার গোফজোড়া। ঝড়ের সময়ে সে উঠেছিল ও পারে গঞ্জের ঘাটের পাকুর গাছে । দমকা হাওয়া যেমনি লাগল। গাছ পড়ল ভেঙে পদ্মায় । বাঘ ভায়া ভেসে যায় জলের তোড়ে । খাবি খেতে খেতে উঠল এসে চরে । তাকে দেখেই আমার রশিতে লাগালুম ফাস । জানোয়ারটা এত্তো বড়ো চোখ পাকিয়ে দাড়ালো আমার সামনে । সঁতার কেটে তার জমে উঠেছে খিদে ৷ আমাকে দেখে তার লাল টকটকে জিভ দিয়ে নাল ঝরতে লাগল। বাইরে ভিতরে অনেক মানুষের সঙ্গে তার চেনাশোনা হয়ে গেছে, কিন্তু আবদুলকে সে চেনে না। আমি ডাক দিলুম ‘আও বাচ্ছা । সে সামনের দু পা তুলে উঠতেই দিলুম তার গলায় ফাস আটকিয়ে, ছাড়াবার জন্যে যতই ছটফট করে ততই ফাস ঐটে গিয়ে তার জিভ বেরিয়ে পড়ে।” এই পর্যন্ত শুনেই আমি ব্যস্ত হয়ে বললুম, “আবদুল, সে মরে গেল নাকি ৷” আবদুল বললে, “মরবে তার বাপের সাধ্যি কী। নদীতে বান এসেছে, বাহাদুরগঞ্জে ফিরতে হবে তো ? ডিঙির সঙ্গে জুড়ে বাঘের বাচ্ছাকে দিয়ে গুণ টানিয়ে নিলেম অন্তত বিশ ক্রোশ রাস্তা। গোগো করতে থাকে, পেটে দিই দাড়ের খোচা, দশ-পনেরো ঘণ্টার রাস্তা দেড় ঘণ্টায় পৌঁছিয়ে দিলে। তার পরোকার কথা আর জিগগেস কোরো না বাবা, জবাব মিলবে না। আমি বললুম, “আচ্ছা বেশ, বাঘ তো 'হল, এবার কুমির ? আবদুল বললে, “জলের উপর তার নাকের ডগা দেখেছি অনেকবার। নদীর ঢালু ডাঙায় লম্বা হয়ে শুয়ে সে যখন রোদ পোহায়, মনে হয় ভারি বিচ্ছিরি হাসি হাসছে। বন্দুক থাকলে মোকাবিলা করা যেত। লাইসেন্স ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু মজা হল। একদিন কঁচি বেদেনি ডাঙায় বসে দা দিয়ে বাখারি চািচছে, তার ছাগলছােনা পাশে বাধা । কখন নদীর থেকে উঠে কুমিরটা পাঠার ঠ্যাঙ ধরে জলে টেনে