পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓ8br রবীন্দ্র-রচনাবলী পাড়ায় এক-একজন নামজাদা অধিকারীর অধীনে যাত্রার দল গজিয়ে উঠত। দলকর্তা অধিকারীরা সবাই যে জাতে বড়ো কিংবা লেখাপড়ায় এমন কিছু তা নয়। তারা নাম করেছে,আপনি ক্ষমতায় । আমাদের বাড়িতে যাত্রাগান হয়েছে মাঝে মাঝে । কিন্তু রান্তা নেই, ছিলুম ছেলেমানুষ। আমি দেখতে পেয়েছি তার গোড়াকার জোগাড়-যন্তর। বারান্দা জুড়ে বসে গেছে দলবল, চারিদিকে উঠছে তামাকের ধোয়া । ছেলেগুলো লম্বা-চুল-ওয়ালা, চোখে-কালি পড়া, অল্প বয়সে তাদের মুখ গিয়েছে পেকে। পান খেয়ে খেয়ে ঠোঁট গিয়েছে। কালো হয়ে । সাজগোজের আসবাব আছে রঙকর টিনের বাক্সোয় । দেউড়ির দরজা খোলা, উঠোনে পিল পিল করে ঢুকে পড়ছে লোকের ভিড় । চার দিকে টগবগ করে আওয়াজ উঠছে, ছাপিয়ে পড়ছে। গলি পেরিয়ে চিৎপুরের রান্তায় । রাত্রি হবে নাটা, পায়রার পিঠের উপর বাজপাখির মতো হঠাৎ এসে পড়ে শ্যাম, কড়া-কড়া শক্ত হাতের মুঠি দিয়ে আমার কনুই ধরে বলে, “মা ডাকছে, চালো শোবে চলে ।” লোকের সামনে এই টানা হেঁচড়ায় মাথা হেঁট হয়ে যেত, হার মেনে চলে যৌতুম শোবার ঘরে । বাইরে চলছে হঁকডাক, বাইরে জ্বলছে "বাড়লন্ঠন, আমার ঘরে সাড়াশব্দ নেই, পিলসুজের উপর টিম টিম করছে পিতলের প্রদীপ । ঘুমের ঘোরে মাঝে-মাঝে শোনা যাচ্ছে নাচের তাল সমে এসে ঠেকতেই ঝমােঝম করতাল । সব-তাতে মানা করাটাই বড়োদের ধর্ম। কিন্তু একবার কী কারণে তঁদের মন নরম হয়েছিল, হুকুম বেরল, ছেলেরাও যাত্রা শুনতে পাবে। ছিল নালন্দময়তীর পালা। আরম্ভ হবার আগে রাত এগারোটা পর্যন্ত বিছানায় ছিলুম ঘুমিয়ে। বার বার ভরসা দেওয়া হল, সময় হলেই আমাদের জাগিয়ে দেবে } উপরওয়ালাদের দন্তুর জানি, কথা কিছুতেই বিশ্বাস হয় না, কেননা তারা বড়ো আমরা ছোটাে ! সে রাত্রে নারাজ দেহটাকে বিছানায় টেনে নিয়ে গেলুম। তার একটা কারণ, মা বললেন তিনি স্বয়ং আমাকে জাগিয়ে দেবেন, আর-একটা কারণ নাটার পরে নিজেকে জাগিয়ে রাখতে বেশ-একটু ঠেলা ঠেলির দরকার হত। এক সময়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে আমাকে নিয়ে আসা হল বাইরে। চোখে ধাধা। লেগে গেল। একতলায় দোতলায় রঙিন ঝাড়লষ্ঠান থেকে বিলিমিলি আলো ঠিকরে পড়ছে চার দিকে, সাদা বিছানো চাদরে উঠোনটা চোখে ঠেকছে মন্ত । এক দিকে বসে আছেন বাড়ির কর্তারা আর র্যাদের ডেকে আনা হয়েছে। বাকি জায়গাটা যার খুশি যেখান থেকে এসে ভরাট করেছে। থিয়েটারে এসেছিলেন পেটে-সোনার-চেন-ঝোলানো নামজাদার দল, আর এই যাত্রার আসরে বড়োয় ছোটোয় ঘেঁষার্থেবি। তাদের বেশির ভাগ মানুষই, ভদ্রলোকেরা যাদের বলে বাজে লোক। তেমনি আবার পালাগানটা লেখানো হয়েছে এমন-সব লিখিয়ে দিয়ে যারা হাত পাকিয়েছে খাগড়া কলমে, যারা ইংরেজি কপিবুকের মকশো করে নি। এর সুর, এর নাচ, এর সব গল্প বাংলাদেশের হাট ঘাট মাঠের পয়দা-করা ; এর ভাষা পণ্ডিতমশায় দেন নি পালিশ করে । সভায় যখন দাদাদের কাছে এসে বসলুম, রুমালে কিছু কিছু টাকা বেঁধে আমাদের হাতে দিয়ে দিলেন । বাহবা দেবার ঠিক জায়গাটাতে ঐ টাকা ছুড়ে দেওয়া ছিল রীতি। এতে যাত্রাওয়ালার ছিল উপরি পাওনা, আর গৃহস্থের ছিল খোশনাম। রাত ফুরোত, যাত্রা ফুরোতে চাইত না । মাঝখানে নেতিয়ে-পড়া দেহটাকে আড়াকোলা করে কে যে কোথায় নিয়ে গেল জানতেও পারিনি। জানতে পারলে সে কি কমলজা । যে মানুষ বড়োদের সমান সারে বসে বকশিশ দিচ্ছে ষ্টুড়ে, উঠোনসূদ্ধ লোকের সামনে তাকে কিনা এমন অপমান। ঘুম যখন ভাঙল দেখি মায়ের তক্তপোশে শুয়ে আছি। বেলা হয়েছে বিস্তর, বঁটা বঁটা করছে রোদন্দুর । সূর্য উঠে গেছে। অথচ আমি উঠি নি, এ ঘটে নি। আর কোনোদিন । শহরে আজকাল আমোদ চলে নদীর স্রোতের মতো । মাঝে-মাঝে তার ফাক নেই। রোজই যেখানে-সেখানে যখন-তখন সিনেমা, যে খুশি ঢুকে পড়ছে সামান্য খরচে । সেকালে যাত্রাগান ছিল যেন শুকনো গাঙে কোশ-দুকোশ অন্তর বালি খুঁড়ে জল তোলা। ঘণ্টা কয়েক তার মেয়াদ, পথের BDB D BBB LS DDB DD BD D DBSS আগেকার কালটা ছিল যেন রাজপুত্ত্বর। মাঝে মাঝে পালপার্বণে যখন মজি হােত আপন এলেকায়